আফতাবের আফসোস

  আফতাবের আফসোস (revised)

আফতাবের  বিরাট  গোঁফ, ইন্ডিয়ার মিলিটারি অফিসারদের মতন।  আমার থেকে  বছর পাঁচেকের ছোট  হবে।  হায়দ্রাবাদের অভিজাত পরিবারের ছেলে। বাড়ির অনেকেই আমেরিকায় চলে এসেছে, ওকেও ওই সুত্রে  একটা গ্রীন  কার্ড পাইয়ে দিয়েছে। সময়টা     অনেকদিন আগে – ১৯৯০ নাগাদ, এখন আর গ্রীন  কার্ড পাওয়া অত সোজা নয়।

জায়গাটা আমেরিকার  ক্যানসাস  প্রদেশ – কিন্তু তখনো ইন্টারনেট নেই, সেল ফোন সবে সুরু হয়েচে। অনেক কাগজ আর ম্যাগাজিন বেরত তখন , লোকে  তাই পড়ত।

একটু  আমার নিজের ঢাক না বাজালে আফতাবের প্রতি আমার মনোভাব বুঝতে পারবেন না। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ ওই দশ বছর আমি মারাত্বক খেটেছি , অনেক গবেষণা  করেছি, তার ফল নামকরা পত্রিকায় ছাপিয়েছি,  চাকরিতে প্রমোশন পেয়েছি,  বাড়ি  কিনেছি, ছেলের যত্ন করেছি, বেশ কিছু টাকাও  জমিয়েছি । শুধু আমি নয়, প্রচুর কলেজের তরুন অধ্যাপকেরা  এই বয়েসে  এই কাজগুলোই করে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি আফতাবকে দেখে অবাক হয়ে যেতাম। প্রায় আমার বয়েসি একটা   লোক, আমেরিকায় এসেছে,  – উদ্দেশ্য পড়াশোনা করবে, চাকরি বা ব্যাবসা করবে, সংসার করবে তার পরে । পরিবারের টাকা আছে, ওকে গ্রীন কার্ড করে দিয়েছে, দাদা দিদি আর কাকা  ফামিলি নিয়ে আমেরিকার বিভিন্ন সহরে থাকে। বুদ্ধি আছে মোটামুটি, ইংরাজি ভালই বলে।

তবে? একটার  পর একটা গণ্ডগোল ওই পাঁচ বছরে ও দেখিয়ে দিল একেবারে! ওর সর্বনাশ ,  ওর ফ্যামিলির সর্বনাশ, সকলের মাথা খারাপ হবার জোগাড়।  ওকে কি বলব, অভাগা, হতভাগা, কেলানে,না ইডিয়ট, তা এখনো ঠিক করতে পারিনি। 

প্রথম অধ্যায়ঃ আফতাবের শিক্ষাদীক্ষা  

আমার সঙ্গে আফতাবের দেখা কলেজ ক্যাম্পাসে – দেখি বিরাট গোঁফ নিয়ে ট্র্যাফিক কন্ট্রোল বুথে বসে আছে । ক্যাম্পাসের যে সব রাস্তায় প্রচুর ছাত্ররা হেঁটে  হেঁটে  এক ক্লাস থেকে   অন্য ক্লাসে যেত , সেই সব রাস্তায় কলেজের সিকুরিটি   গারডরা   গাড়ি কন্ট্রোল করত। । ওকে দেখে কৌতূহল হল, তখন ভারতীয়রা হয় অধ্যাপক নয় ছাত্র হিসাবে আসত । সিকুরিটি   গারডের কাজ করতে হলে  ওয়ার্ক ভিসা লাগবে, ছাত্ররা ওই  কাজ করতে পারত না।

 “কোথা থেকে? পাকিস্তান না হিন্দুস্তান?” জিজ্ঞাসা করলাম।

“ স্যার, আমি ইন্ডিয়ার লোক – হায়েদ্রাবাদ থেকে।“ বলল আফতাব। 

কিছুদিন পরে দেখি আমার ইকনমিক্স ডিপার্টমেন্টে ঘোরাঘুরি  করছে।

“কি করছ এখানে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“এই আমার মাস্টার ডিগ্রিটা  শেষ করছি , মোটে তিনটে কোর্স বাকি আছে। “ আফতাব জানাল।

“ আগের কোর্সগুলো কোথায়  করেছ?”  আমি জানতে চাইলাম।

“ওহায়ো  প্রদেশের   ছোট কলেজে যখন আমি দাদার কাছে থাকতাম। এখন ত এখানে চাকরি করি,  তাই টুইশন ২০% কম লাগে আর অনেক ভাল  এই কলেজটা ।“

“বেশ। গুড  লাক। মন দিয়ে পড়াশোনা কর “।

আমার কাছে ও  কোন  কোর্সে  এনরোল  করল না।  সহকর্মীদের কাছে  শুনলাম, খুবই    সাধারন ছাত্র ।

কয়েক মাস পরে  ও আমার অফিসে এল

“কোর্স সব শেষ হয়ে গেছে  গৌতমদা, শুধু  একটা মাস্টার্স  থিসিস লেখা বাকি আছে। “

আমি খুব খুশি হলাম “ আমি তোমার  মাস্টার্স  থিসিস -এর অ্যাডভাইসার হব। তুমি টপিক  ঠিক কর, একটা রিসার্চ প্ল্যান রেডি কর, আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব কি করে কাজ করতে হবে। শুরু করে দাও, দেরি কোর না। ঠিক  করে  সুরু করলে, ছমাসের মধ্যে সব শেষ হয়ে যাবে । এটা  পি এইচ ডি  থিসিসের মত নয়, তার থেকে অনেক সোজা। 

এই কথা হবার পরে প্রায় একবছর কেটে গেল। আফতাব বার তিনেক আমার অফিসে এল, একটা দুটো  টপিক নিয়ে কথা বলল, কিন্তু ওই  পর্যন্ত । কোন লিখিত প্ল্যান নেই, কোন প্রপোসাল নেই, কোন প্রগ্রেস হল না। আমি হাল ছেড়ে দিলাম । বড়লোকের ছেলে, পরিবারের চার জন লোক আমেরিকায় থাকে, গ্রীন কার্ড আছে ( যেখানে খুশি চাকরি করতে পারবে), কি দরকার ওর মাস্টার্স করে –  এই বলে নিজেকে বোঝালাম।

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ আফতাবের দোকান  

মাস দুয়েক পরে আফতাবের ফোন “ গৌতম দা, চাচাজি আর আমি  দোকান খুলছি। ইন্ডিয়ান গ্রোসারির দোকান , একটাই বড় দোকান  আছে ক্যানসাস সিটির পশ্চিমদিকে, আমরা আর একটা  নতুন  দোকান  খুলব ।

সেই সময় ইন্টারনেট শপিং ছিল  না, আমেরিকার সুপারমার্কেটগুলো অল্পসল্প ইন্ডিয়ান জিনিষ রাখত  –  একটু চাল ডাল হলুদ গুড়ো  লঙ্কা গুড়ো – আর কিছু না । ফলে প্রত্যেক  বড়  সহরেই

ভারতীয় মার্কেট ছিল, প্রবাসী ভারতীয়দের চাহিদা মেটানোর  জন্য ।   চতুর্দিকে আমেরিকান

খাবার, আমেরিকান জামাকাপড়, আমেরিকান স্পোর্টসের সরঞ্জাম, আমেরিকান ফারনিচার, এইসব দোকানের  মধ্যে একটা ইন্ডিয়ান দোকান   – এখানে  ঢুকেই মনে হত অন্য দেশে চলে এসেছি । আতরের গন্ধ, ধুপের গন্ধ, কত সকমের চাল ডাল , আর মশলা , আচার, পাঁপ্‌র, বাদাম, শুকনো ফল,  বিস্কুট , আরও  কত রকমের ইন্ডিয়ান খাবার!  আবার একটা কোণে  ইন্ডিয়ান সিনেমার ডি ভি ডি ভাড়া দেওয়া হচ্ছে, আর এক দিকে ভাল ভাল ইন্ডিয়ান শাড়ি আর জামা বিক্রি হচ্ছে। ছুটির দিন সকালে আবার  টাটকা জিলিপি আর সামোসা!

ক্যানসাস সিটির পশ্চিমদিকে , একটাই ইন্ডিয়ান দোকান  ছিল, তার মালিক ছিলেন রুস্তম আর ওর দুই বয়স্ক  মেয়ে। রুস্তমের বয়েস প্রায় পঞ্চাশ  তখন, বেশ হৃষ্টপুষ্ট বলবান চেহারা।

 আমার সঙ্গে একটু পরিচয় ছিল,  আফতাবের প্লান শুনে  একদিন দোকান  করার ছলে  রুস্তমের  দোকানে  গেলাম। একটু গল্প করতে শুরু করলাম ওর সংগে।  দেখি কি ওর ইংরাজি বুঝতে পারছি কিন্তু ওর  হিন্দি একেবারে  উর্দুর মতো  আর প্রচুর আরবি শব্দ মেশানো – আমার বাঙালি কান কিছুই ধরছে না।

“আপনি কি পাকিস্তানের লোক?” আমি জিজ্ঞাসা  করলাম

“না আমি ইডেন ওয়ালা! “ উনি হেসে বললেন।

“মানে? ইন্ডিয়াতে ইডেন বলে কোন জায়গা আছে না কি?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“ মধ্যপ্রাচ্যের  ইয়েমেনের একটা বিখ্যাত বন্দরের নাম ইডেন (Aden).  সেখানে প্রচুর প্রবাসী ভারতীয়  আর অন্য বিদেশী  লোকেরা থাকত ।  ওখানের    ব্যাবসায়িদের  বলে ইডেন ওয়ালা।“

“ওদের কোন বৈশিষ্ট্য আছে?” আমি একটু চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলাম।

“আছেই তো” উনি হেসে বললেন  ”আমরা মরুভুমির ইয়েমেনিদের মত, শত্রুকে একেবারে শেষ করে ফেলি, কোন সন্ধি করি না, কোন আপোষ করি না! No prisoners!  হা হা হা!

আমি বেশ চিন্তিত হয়ে গেলাম   এটা  শুনে।

যাকগে  , আফতাবের দোকান , ইন্ডিয়া কর্নার,   খোলা  হল খুব সাজিয়ে গুজিয়ে। ভেতরে আফতাবের প্রিয় হিন্দি সিনেমার গান  চলল সারাদিন। আমার বেশ পছন্দ হয়েচিল ইন্ডিয়া কর্নার,    জিনিষের  দামও  মোটামুটি কমের দিকে।

দুমাস ভালই চলল, তারপরে খদ্দের আসা খুব কমে গেল হটাত । আফতাব  খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আমাকে ফোন করল।

“গৌতমদা , দোকানে কোন লোক নেই, মাছি তাড়াচ্ছে একেবারে। কি করি বলুন ত? “

আমি বললাম “ দেখ, একবার একটা  গুপ্তচর  পাঠিয়ে  দাও রুস্তমের  দোকানে , দামগুলো যাচাই করে আসুক।“

গুপ্তচরের রিপোর্ট  সুবিধার হল না। রুস্তমের দোকানে প্রায় সব কিছুর  দামই ১৫% থেকে ৪০% কম! ক্রেতারা কেন আর আফতাবের দোকানে  আসবে?

“শোন আফতাব” আমি বললাম বুঝিয়ে “ অনেক সময় পুরনো  বিক্রেতা  এই রকম দাম কমিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য  হচ্ছে অন্যদের লোকসান  করিয়ে  দেওয়া, এইরকম কিছুদিন চললে নতুন বিক্রেতা লাল বাতি  জ্বালাবে । সমস্যা হচ্ছে যে নতুন বিক্রেতাও আবার দাম কমিয়ে দিতে পারে, তখন দুজনেরি রোজ  লোকসান হবে – যাকে বলে  দামের  যুদ্ধ লেগে যাবে। এরকম ব্যাবহারকে অর্থনীতিতে বলে  predatory -price -cutting. যদি আদি বিক্রেতার পকেটের জোর  বেশি থাকে, তাহলে  লোকসান সহ্য  করেও সে নতুনদের  দেউলিয়া করে দিতে পারে। তারপর সবাই চলে গেলে আদি বিক্রেতা আবার দাম বাড়িয়ে  দেবে, অনেক লাভ করবে।

যদি রুস্তমজি সত্যি এই খেলা খেলতে চায়, ওকে ঠেকানোর জন্যে অনেক কিছু  করতে পার। তুমিও দাম কমাবে কিন্তু একটা ম্যাক্সিমাম লোকসা্নের বেশি নেবেনা। আর দাম ছাড়াও অন্যভাবে খদ্দের আনার চেষ্টা কর। যাদের একটু চেন, তাদের স্পেশাল ডিসকাউনট  দেবে,  এমন সব মশলা  আর খাবার আনবে যা রুস্তমের দোকানে পাওয়া যায় না। সন্ধ্যেবেলা তোমার চাচিকে  বলবে  পাকোড়া ,  সামোসা এইসব একটু  করে দিতে,  খদ্দেরদের ফ্রীতে দিয়ে দেবে।

দেখবে কিছুদিন পরে রুস্তমজির মাথায় টনক নড়বে , তখন আস্তে আস্তে  দাম বাড়িয়ে  দেবে। অনেক খদ্দের আছে এই বাজারে, দুজন বিক্রেতা অনায়াসে টিকে  থাকতে পারে, যুদ্ধ করার কোন  কারন নেই।

কিন্তু  অর্থনীতিবিদ হিসাবে আমার বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যৎবাণী একেবারে মিথ্যা প্রমান হয়ে গেল। রুস্তমজি একেবারে নিষ্ঠুর   ইডেন ওয়ালার মত ব্যাবহার করলেন, আফতাবকে শেষ না করে ফেলা পর্যন্ত ওনার  শান্তি  রইল না। ছমাস ধরে সবকিছুর দাম একেবারে কমিয়ে রাখলেন রুস্তমজি, আফতাবের আর  কোন   আশা রইল না।  শেষ  পর্যন্ত দোকানের স্টক , আসবাবপত্র, সবই  জলের দরে বেচে দেওয়া হোল।

তৃতীয়  অধ্যায়ঃ আফতাবের বান্ধবী

ওমা, মাস দুই পরে চাচাজির ফোন ঃ  “ গৌতম স্যার, একটু আফতাবের সঙ্গে কথা বলুন । দোকান তুলে দেওয়ার পরে সব জিনিশপত্র, আসবাবপত্র বেচে দিয়ে প্রায় কুড়ি  হাজার ডলার হয়েছিল ( ষোল  লক্ষ টাকা)। আফতাবের  একাউনটে এই টাকা ছিল, ও সব টাকা নষ্ট করে দিচ্ছে ।

“সে কি! কি করছে কি?” আমি জানতে চাইলাম

“হামেশাই লাস ভেগাস  যাচ্ছে জুয়া খেলতে। আর  ক্যানসাসের বাডা বিং  ক্লাবে যাচ্ছে  প্রায় রোজই।“

“এই মরেছে! সর্বনাশ!” আমি তড়াক করে উঠে আফতাবকে ফোন  করলাম।

“ কি , চাকরিবাকরি পেয়েছ? কি করছ এখন?”

“না দাদা, এখনো সুবিধামত কিছু পাই নি, খুঁজছি ।“ আফতাব বলল ।

তুমি নাকি ভেগাসে যাচ্ছ জুয়া খেলতে?

“হ্যাঁ দাদা দুবার গিয়েছি, একবার আড়াই লক্ষ টাকা  জিতেছি আর একবার সাড়ে  তিন লক্ষ  টাকা হেরেছি  ব্ল্যাক জ্যাক খেলে। খেলতে আমার ভালই লাগে, কিন্তু এখান  থেকে প্লেনে  করে যেতে হয়, যেতে একদিন, আসতে  এক দিন – ও আমার পোষাবে  না , আর যাব না ঠিক করেছি।

“ আর তুমি নাকি বাডা বিং ক্লাবে যাচ্ছ রোজই”,

“হ্যাঁ, সপ্তাহে তিন চারদিন, বিরাট মজা। কালকে দুপুরে আমার সঙ্গে ওখানে চল, কথা হবে। “

এই ক্লাব, বাডা বিং, এর অনেক অন্য গল্প আছে আপনাদের পরে শোনাব , এখন খুব ছোট করে বলে দিচ্ছি। সহরের বাইরে  এটা  একটা স্ট্রিপ বার, মেয়েরা ষ্টেজের  ওপর  উঠে নাচে আর ওপরের জামা খুলে ফেলে সব।     স্টেজ থেকে নেমে মেয়েরা দর্শকদের  সঙ্গে মিশতে পারে, কিন্তু কোনরকম গায়ে হাত দেওয়া বারণ ।  কোনরকম  আর্থিক চুক্তি বা যৌন সঙ্গের  প্রস্তাব দেওয়াও বারন , যদিও গোপনে সবই  চলত।  দুজন দৈত্যের মত সিকিউরিটি গার্ড (bouncer) রেডি থাকত –  কেউ কিছু নিয়ম ভাঙলে হাসি হাসি মুখ করে তার পাশে এসে দাঁড়াত। সে কিছু

করার  আগেই  তাকে চ্যাংদোলা করে বারের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিত। কোনোদিন     এদের মারপিট করতে দেখিনি!! দরকারই  হয়নি!

সন্ধ্যেবেলা ওই  বারে ভিড়  হয় ভাল, লোকে  মদ খেয়ে হুল্লোড়  করতে আসে।

 কিন্তু আমি আর আফতাব দুপুর  আড়াইটে   নাগাদ গেলাম ওখানে।  মোটামুটি  ফাঁকা , কয়েকটা মাতাল টেবিলে ধুকছে,  কয়েকটা লোক  মেয়ে পটাতে  এসেছে। আর দেখলাম কিছু পাগল উকিল আর  ব্যাবসায়ি  টেবিলে  বসে অফিসের কাজ করছে,  আর নাচ দেখছে আর বিয়ারও খাচ্ছে। মালটি – টাসকিং -এর একেবারে হদ্দমুদ্দ !!

মেয়েদের দেখলাম, সবাই  সাদা আমেরিকান মেয়ে, দুজন ছাড়া সবাইকেই সাধারন দেখতে, যদিও সকলেরি ফিগার ভাল । দুজন সুন্দরীর  মধ্যে একজনের কালো চুল, মুখ চোখ সাংঘাতিক  সুন্দর , আর একটু উদ্ধত মেজাজ সবসময়, নাম তার  সানিয়া , সেই আফতাবের  বান্ধবী ।

আমিও সানিয়াকে  দেখে মুগ্ধ !  আবার আফতাবের জন্য চিন্তাও হল।

“এ তো  বাংলায় যাকে বলে femme fatale , একে ম্যানেজ করছ কি করে “ আমি প্রশ্ন করলাম

“খুব টেনশন হচ্ছে দাদা। মেয়েটা সপ্তাহে দু তিন দিন সন্ধ্যেবেলা আমার ফ্ল্যাটে আসে। আমাদের  শারীরিক      সম্পর্ক  একেবারে ভল্ক্যানিক , প্যাসনেট , ফাটাফাটি ! কিন্তু ভবিষ্যতে কি হবে জানি না। “

“আমি আন্দাজ করতে    পারছি ।“  আমি বললাম “এর জন্য টাকা কিরকম খরচা করেছ? কিছু  বড় উপহার দিয়েছ? “

“হ্যাঁ দাদা, আমি তো একে না বলতে পারি না । একটা  পুরনো  গাড়ি  কিনে দিয়েছি , আর ওর  জন্মদিনে একটা  হিরের  আংটি  দিয়েছি , ক্যাশ  টাকাও  দিয়েছি  অনেকবার” ও স্বীকার করল

“ সর্বনাশ!  মনে হচ্ছে femme fatale শীঘ্রই ফুটবে, সাবধানে থেক”

এই কথা শুনে আফতাবের রাগ হয়ে গেল, সানিয়াকে নিয়ে একটা অন্য টেবিলে গিয়ে বসল । আমিও কিছুক্ষণ পরে বাড়ি চলে এলাম। চাচাজিকে  ফোন  করে সব বলে দিলাম। চাচাজি  খুব রেগে গিয়ে আফতাবের  একাউনটে  মোটে  আট লক্ষ টাকা পড়েছিল সেটা তুলে নেবেন বললেন। খুব রেগে গিয়ে গালাগালিও দিলেন

“কি কুলাঙ্গার ছেলে! ফ্যামিলির দেওয়া ব্যাবসার টাকা নিয়ে মেয়েদের হিরের আংটি কিনে দিচ্ছে!!  আর এক পয়সাও ওকে ব্যাবসার জন্য দেব না ভবিষ্যতে “।

চতুর্থ অধ্যায়ঃ প্রেম এবং বিবাহ

তারপরে ছয়মাস কোন খবর নেই। একদিন  ফোন  এল “দাদা, একটা  ব্যাংকে  চাকরি    পেয়েছি, টাকা পয়সা  মোটামুটি , সানিয়ার ভুত মাথা থেকে নেবেছে এতদিনে ।

“এবার সংসার করার কথা ভাবো” আমি বললাম।

“ হুম, চাচাজির ফ্যামিলি এখনো খুব চটে আছে,  আমার আমেরিকাবাসী দাদারাও চটে আছে । ওরা কেউ আমাকে সাহায্য করবেনা। আমি দেশে আমার মাকে বলেছি , আর এখানে ভারতীয় ম্যাগাজিন গুলোয় পাত্র পাত্রীর  বিজ্ঞাপন দেখছি । 

“খুব আস্তে আস্তে  এগোবে “ আমি বললাম। “ দরকার হলে আমাকে ফোন করবে।

কয়েকদিন পরে আফতাব খুব খুশী হয়ে আমাকে জানাল যে  নিউ ইয়র্ক সহরে এক  ভারতীয়  ঘটক (matchmaker) – এর  খবর  পেয়েছে, তারা ওকে  দশজন মেয়ের প্রোফাইল আর  ফোনের

খবর পাঠিয়ে  দিয়েছে , ভবিষ্যতে আরও  পাঠাবে !

একজনকে পছন্দ হোল আফতাবের, নাম তার সীমা , আমেরিকায় বড়   হয়েছে  বাঙালি মেয়ে, খুব কিউট দেখতে। আমাকে বলল, ওর সঙ্গে   রোজই    ফোনে  কথা হচ্ছে। আমি খুব খুশি হলাম।

সীমা থাকে  কলোরাডোতে, এখান থেকে প্রায় আটশ কিলোমিটার  দূরে ।   ফোনে , চিঠিতে একটা ছুইট প্রেম হচ্ছে খবর পেলাম, আফতাব বার দুয়েক গিয়ে সীমার  সঙ্গে দেখাও করে আসলো ।

ঝামেলা শুরু হয়ে গেল দুই ফামিলিকে নিয়ে। চাচাজি একেবারেই বাঙালি হিন্দু মেয়ের সঙ্গে আফতাবের বিয়েতে রাজি হলেন না, সীমার বাবা মাও মুসলিম ছেলের সঙ্গে বিয়েতে রাজি নয়।

আমি আফতাবের সঙ্গে দেখা করলাম।

“দেখ , তোমাদের  তিরিশের  ওপরে  বয়েস।  আমেরিকাতে সারা জীবন থাকবে। ফ্যামিলির মতামতকে কোন গুরুত্ব  দেবার দরকার নেই। নিজেরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে কোরে নাও,  তোমাদের   দুজনের  কলেজের ডিগ্রি আছে দুজনেরি  গাড়ি  আছে , আফতাবের গ্রীন কারড  আছে আর সীমা  তো আমেরিকার নাগরিক। চাকরির বাজার  এখন  বেশ ভাল,  কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভাল চাকরি পেয়ে যাবে। তোমরা একটু দাঁড়িয়ে গেলে, তোমাদের বাবা মা ফ্যামিলি সব আবার ফিরে আসবে আমি কথা দিচ্ছি। 

আমি ওর  সঙ্গে গেলাম কলোরাডোর ডেনভার সহরে , রেজিস্ট্রি অফিসে ওদের  বিয়ে হল, আমি সাক্ষী দিলাম। ওরা একটা ছোট  ফ্ল্যাটে  চলে গেল, আমিও ফিরে এলাম।

ফোন এল কয়েকদিন পরে

“সব ঠিকঠাক , আফতাব?”

“হা স্যার সব ঠিক মত চলছে, কিন্তু  ভাল চাকরি এখনো পাই নি। একটা কথা বলব দাদা?”বলতে সংকোচ হচ্ছে।“

“কি ব্যাপার”?

“এই মানে আমাদের স্বামী -স্ত্রীর সম্পর্কটা  এখনো  পাকাপাকি  হয় নি”

“মানে”? আমি ত অবাক – তোমরা ত কয়েক মাস ধরে ডেট করেছ, তুমি বার তিনেক  সীমার সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছ, তাই না?”

“ঠিক। কিন্তু তখন তো সম্পর্ক  পুরো হয় নি , সীমা    বলেছিল বিয়ের পরে সব ঠিক  হয়ে যাবে। এখন বলছে আমরা আরও অপেক্ষা করব। আগে ভাল চাকরি  হবে, আর্থিক  সচ্ছলতা আসবে , তবে স্বামী -স্ত্রীর মত রিলেশন শুরু হবে, এখন আমরা এক বাড়িতে ভাই    বোনের মত থাকি।“

“কি কাণ্ড “ আমি তো  অবাক “ ও  তোমার   বিয়ে  করা বৌ  তো, এইসব আবার কি ঢং  বলতো।“

“কি করি বলুন ত?” আফতাব  খুব উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল।

“আমি জানি না।  মনে হচ্ছে  এ বিয়ে নাও টিকতে পারে”।

তারপরের ঘটনা আফতাবের কাছ থেকে শোনা । কয়েক সপ্তাহ পরে একদিন দুপুরে হটাত  সীমার  মা চলে এলেন। বললেন নিজেই ঠিকানা  খুজে বের করেছেন (হতে পারে ওর  মেয়েই

ডেকেছিল) । মা মেয়েতে মুখোমুখি বসে একটু ফোঁস ফোঁস করল, তারপরেই মার অঝোরে কান্না, “আমার কাছে ফিরে আয়, খুকি, একি করছিস তুই”  এইসব বলে যাচ্ছেন, কান্না আর থামে না। তারপরে সীমা আর ওর  মা  দুজনকে জড়িয়ে ধরে আবার অনেক কান্না। শেষ  কালে সীমা ভেঙ্গে পড়লো,ঠিক  করল মার সঙ্গে বাড়ি  চলে যাবে।

“আই লাভ ইউ, আফতাব, কিন্তু আমার মা খুব কষ্ট পাচ্ছে, আমি সাত দিন মার সঙ্গে থাকি তারপর ফিরে আসব।“ এই বলে সীমা চলে গেল । তারপর প্রায় সাত সপ্তাহ হয়ে গেল সীমার আর দেখা নেই,  শুধু  মাঝে মাঝে গভীর  প্রেমের চিঠি আসে, তাতে নতুন সব প্রতিজ্ঞা থাকে।

সীমার  বাড়ির ফোনও বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় তিন মাস অপেক্ষা  করে আফতাব ক্যানসাসে ফিরে এল চাচাজির কাছে।

পঞ্চম অধ্যায়ঃ হায়দ্রাবাদ

এই অংশটা কিন্তু একেবারে  অপ্রত্যাশিত ।

ক্যানসাসে আফতাব ভীষণ  ভাবে ডিপ্রেসনে ভুগতে সুরু করল,  ডাক্তাররা বললেন  ও  সুইসাইড  করার চেষ্টা  করতে পারে। চাচাজি ওকে জোর কোরে দেশে পাঠিয়ে  দিলেন।

হায়দ্রাবাদে তখন সবে  outsourcing এর   কোম্পানিগুলো  খুলতে শুরু করেছে , বিসনেস, অর্থনীতি , কমপিউটার , এইসব যারা জানে তাদের    ভীষণ  চাহিদা । আফতাবকে জোর করে  চাকরির  ইন্টার্ ভিউতে পাঠান হোল। ওমা, একটা ছোট আই টি কম্পানি ওকে HR বিভাগে সহকারী ম্যানেজার -এর পদে কাজ দিলো।

আফতাবের মন  তখনো খূব খারাপ ।

আমার সংগে ফোনে কথা  হোলো

“গৌতমদা, কাজ একটা পেয়েছি। আমাকে কিছু  কম্ বয়েসি আই টির লোকেদের  ম্যানেজার করে দিয়েছে। ওদের সঙ্গে কাজ করতে ভালই লাগছে। কিন্তু সীমাকে বড় মিস করছি। কি করে ওকে এখানে নিয়ে আসা যায় বলুন তো? “

আমি আর ওকে বেশী  ঘাটাইনি। ওর  বাড়ির লোক অনেক আছে , তারাই ওকে শান্ত  করবে। 

নব্বই এর দশকের শেষে  হায়দ্রাবাদের ভীষণ  উন্নতি হল  খুব কম সময়ের মধ্যেই ।

নতুন অনেক টেক কম্পানি খুলে গেল, নতুন টেক সহর তৈরি হল, চব্বিশ ঘণ্টা  সেখানে অফিসে  কাজ হয়, গাড়ি , বাস, ট্যাক্সি  চলে, রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে , একদম জমজমাট  ব্যাপার ।

আফতাবের কম্পানি সারা পৃথিবীতে ওদের সফট ওয়ার বিক্রি করতে শুরু করল।  আকারে বেড়ে গেল প্রায় কুড়ি গুন ।

আফতাবকে বিরাট  চাকরি দেওয়া হোল HR বিভাগে। ছয়  বছরের মধ্যে আফতাবের জীবন বদলে গেল একেবারে।

 আমার সঙ্গে ফোনে কথা হল ওইসময়

“ খুব ভাল আছি দাদা, বাড়ির  লোক  সম্বন্ধ করে একটা কমবয়সী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে , বাচ্ছা হবে ছমাস পরে। চাকরিতে মাইনে খুবই ভাল  আর আমার সহকর্মীরাও ভীষণ  সাহায্য করে।“

আমি বললাম

“Congratulations! Looks like you turned your life around! I am very happy for you!”

“থ্যাংক ইউ দাদা। আমি এখানেই থেকে যাব  এখন।“ আফতাব বলল ,

“জানেন একটা  বিরাট আফসোস হয় খুব। কেন অত  টাকা খরচা করে আমেরিকায় গিয়েছিলাম? কিছুই ত হলনা,  যাই করতে গিয়েছি, তাতেই বিরাট  গণ্ডগোল  হয়েছে, আমার দুর্দশা, আমার ফামিলির দুর্ভোগ , সব কিছুই ফর নাথিং। আমেরিকায় যাওয়ার কোন  দরকারই  ছিল না।

“ঠিক বলেছ” আমি উত্তর দিলাম “ তোমার ক্ষেত্রে এটা একদম সত্যি। তা  তোমার গ্রীন কারড তো  এখনও ভ্যালিড আছে, একবার আমেরিকায় বেড়াতে  এস। আমি তোমাদের শিকাগো বেড়াতে     নিয়ে যাব গাড়ি  করে”

“ আর একবার রুস্তমের দোকানে  যাবে নাকি”? আমি প্রশ্ন করলাম

“হা হা হা, অবশ্যই যাব,  ওকে ধন্যবাদ দিতে হবে আমার ব্যাবসা লাটে  তুলে দেওয়ার জন্যে “ আফতাব উত্তর দিল।