আফতাবের আফসোস

  আফতাবের আফসোস (revised)

আফতাবের  বিরাট  গোঁফ, ইন্ডিয়ার মিলিটারি অফিসারদের মতন।  আমার থেকে  বছর পাঁচেকের ছোট  হবে।  হায়দ্রাবাদের অভিজাত পরিবারের ছেলে। বাড়ির অনেকেই আমেরিকায় চলে এসেছে, ওকেও ওই সুত্রে  একটা গ্রীন  কার্ড পাইয়ে দিয়েছে। সময়টা     অনেকদিন আগে – ১৯৯০ নাগাদ, এখন আর গ্রীন  কার্ড পাওয়া অত সোজা নয়।

জায়গাটা আমেরিকার  ক্যানসাস  প্রদেশ – কিন্তু তখনো ইন্টারনেট নেই, সেল ফোন সবে সুরু হয়েচে। অনেক কাগজ আর ম্যাগাজিন বেরত তখন , লোকে  তাই পড়ত।

একটু  আমার নিজের ঢাক না বাজালে আফতাবের প্রতি আমার মনোভাব বুঝতে পারবেন না। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ ওই দশ বছর আমি মারাত্বক খেটেছি , অনেক গবেষণা  করেছি, তার ফল নামকরা পত্রিকায় ছাপিয়েছি,  চাকরিতে প্রমোশন পেয়েছি,  বাড়ি  কিনেছি, ছেলের যত্ন করেছি, বেশ কিছু টাকাও  জমিয়েছি । শুধু আমি নয়, প্রচুর কলেজের তরুন অধ্যাপকেরা  এই বয়েসে  এই কাজগুলোই করে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি আফতাবকে দেখে অবাক হয়ে যেতাম। প্রায় আমার বয়েসি একটা   লোক, আমেরিকায় এসেছে,  – উদ্দেশ্য পড়াশোনা করবে, চাকরি বা ব্যাবসা করবে, সংসার করবে তার পরে । পরিবারের টাকা আছে, ওকে গ্রীন কার্ড করে দিয়েছে, দাদা দিদি আর কাকা  ফামিলি নিয়ে আমেরিকার বিভিন্ন সহরে থাকে। বুদ্ধি আছে মোটামুটি, ইংরাজি ভালই বলে।

তবে? একটার  পর একটা গণ্ডগোল ওই পাঁচ বছরে ও দেখিয়ে দিল একেবারে! ওর সর্বনাশ ,  ওর ফ্যামিলির সর্বনাশ, সকলের মাথা খারাপ হবার জোগাড়।  ওকে কি বলব, অভাগা, হতভাগা, কেলানে,না ইডিয়ট, তা এখনো ঠিক করতে পারিনি। 

প্রথম অধ্যায়ঃ আফতাবের শিক্ষাদীক্ষা  

আমার সঙ্গে আফতাবের দেখা কলেজ ক্যাম্পাসে – দেখি বিরাট গোঁফ নিয়ে ট্র্যাফিক কন্ট্রোল বুথে বসে আছে । ক্যাম্পাসের যে সব রাস্তায় প্রচুর ছাত্ররা হেঁটে  হেঁটে  এক ক্লাস থেকে   অন্য ক্লাসে যেত , সেই সব রাস্তায় কলেজের সিকুরিটি   গারডরা   গাড়ি কন্ট্রোল করত। । ওকে দেখে কৌতূহল হল, তখন ভারতীয়রা হয় অধ্যাপক নয় ছাত্র হিসাবে আসত । সিকুরিটি   গারডের কাজ করতে হলে  ওয়ার্ক ভিসা লাগবে, ছাত্ররা ওই  কাজ করতে পারত না।

 “কোথা থেকে? পাকিস্তান না হিন্দুস্তান?” জিজ্ঞাসা করলাম।

“ স্যার, আমি ইন্ডিয়ার লোক – হায়েদ্রাবাদ থেকে।“ বলল আফতাব। 

কিছুদিন পরে দেখি আমার ইকনমিক্স ডিপার্টমেন্টে ঘোরাঘুরি  করছে।

“কি করছ এখানে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“এই আমার মাস্টার ডিগ্রিটা  শেষ করছি , মোটে তিনটে কোর্স বাকি আছে। “ আফতাব জানাল।

“ আগের কোর্সগুলো কোথায়  করেছ?”  আমি জানতে চাইলাম।

“ওহায়ো  প্রদেশের   ছোট কলেজে যখন আমি দাদার কাছে থাকতাম। এখন ত এখানে চাকরি করি,  তাই টুইশন ২০% কম লাগে আর অনেক ভাল  এই কলেজটা ।“

“বেশ। গুড  লাক। মন দিয়ে পড়াশোনা কর “।

আমার কাছে ও  কোন  কোর্সে  এনরোল  করল না।  সহকর্মীদের কাছে  শুনলাম, খুবই    সাধারন ছাত্র ।

কয়েক মাস পরে  ও আমার অফিসে এল

“কোর্স সব শেষ হয়ে গেছে  গৌতমদা, শুধু  একটা মাস্টার্স  থিসিস লেখা বাকি আছে। “

আমি খুব খুশি হলাম “ আমি তোমার  মাস্টার্স  থিসিস -এর অ্যাডভাইসার হব। তুমি টপিক  ঠিক কর, একটা রিসার্চ প্ল্যান রেডি কর, আমি তোমাকে দেখিয়ে দেব কি করে কাজ করতে হবে। শুরু করে দাও, দেরি কোর না। ঠিক  করে  সুরু করলে, ছমাসের মধ্যে সব শেষ হয়ে যাবে । এটা  পি এইচ ডি  থিসিসের মত নয়, তার থেকে অনেক সোজা। 

এই কথা হবার পরে প্রায় একবছর কেটে গেল। আফতাব বার তিনেক আমার অফিসে এল, একটা দুটো  টপিক নিয়ে কথা বলল, কিন্তু ওই  পর্যন্ত । কোন লিখিত প্ল্যান নেই, কোন প্রপোসাল নেই, কোন প্রগ্রেস হল না। আমি হাল ছেড়ে দিলাম । বড়লোকের ছেলে, পরিবারের চার জন লোক আমেরিকায় থাকে, গ্রীন কার্ড আছে ( যেখানে খুশি চাকরি করতে পারবে), কি দরকার ওর মাস্টার্স করে –  এই বলে নিজেকে বোঝালাম।

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ আফতাবের দোকান  

মাস দুয়েক পরে আফতাবের ফোন “ গৌতম দা, চাচাজি আর আমি  দোকান খুলছি। ইন্ডিয়ান গ্রোসারির দোকান , একটাই বড় দোকান  আছে ক্যানসাস সিটির পশ্চিমদিকে, আমরা আর একটা  নতুন  দোকান  খুলব ।

সেই সময় ইন্টারনেট শপিং ছিল  না, আমেরিকার সুপারমার্কেটগুলো অল্পসল্প ইন্ডিয়ান জিনিষ রাখত  –  একটু চাল ডাল হলুদ গুড়ো  লঙ্কা গুড়ো – আর কিছু না । ফলে প্রত্যেক  বড়  সহরেই

ভারতীয় মার্কেট ছিল, প্রবাসী ভারতীয়দের চাহিদা মেটানোর  জন্য ।   চতুর্দিকে আমেরিকান

খাবার, আমেরিকান জামাকাপড়, আমেরিকান স্পোর্টসের সরঞ্জাম, আমেরিকান ফারনিচার, এইসব দোকানের  মধ্যে একটা ইন্ডিয়ান দোকান   – এখানে  ঢুকেই মনে হত অন্য দেশে চলে এসেছি । আতরের গন্ধ, ধুপের গন্ধ, কত সকমের চাল ডাল , আর মশলা , আচার, পাঁপ্‌র, বাদাম, শুকনো ফল,  বিস্কুট , আরও  কত রকমের ইন্ডিয়ান খাবার!  আবার একটা কোণে  ইন্ডিয়ান সিনেমার ডি ভি ডি ভাড়া দেওয়া হচ্ছে, আর এক দিকে ভাল ভাল ইন্ডিয়ান শাড়ি আর জামা বিক্রি হচ্ছে। ছুটির দিন সকালে আবার  টাটকা জিলিপি আর সামোসা!

ক্যানসাস সিটির পশ্চিমদিকে , একটাই ইন্ডিয়ান দোকান  ছিল, তার মালিক ছিলেন রুস্তম আর ওর দুই বয়স্ক  মেয়ে। রুস্তমের বয়েস প্রায় পঞ্চাশ  তখন, বেশ হৃষ্টপুষ্ট বলবান চেহারা।

 আমার সঙ্গে একটু পরিচয় ছিল,  আফতাবের প্লান শুনে  একদিন দোকান  করার ছলে  রুস্তমের  দোকানে  গেলাম। একটু গল্প করতে শুরু করলাম ওর সংগে।  দেখি কি ওর ইংরাজি বুঝতে পারছি কিন্তু ওর  হিন্দি একেবারে  উর্দুর মতো  আর প্রচুর আরবি শব্দ মেশানো – আমার বাঙালি কান কিছুই ধরছে না।

“আপনি কি পাকিস্তানের লোক?” আমি জিজ্ঞাসা  করলাম

“না আমি ইডেন ওয়ালা! “ উনি হেসে বললেন।

“মানে? ইন্ডিয়াতে ইডেন বলে কোন জায়গা আছে না কি?” আমি প্রশ্ন করলাম।

“ মধ্যপ্রাচ্যের  ইয়েমেনের একটা বিখ্যাত বন্দরের নাম ইডেন (Aden).  সেখানে প্রচুর প্রবাসী ভারতীয়  আর অন্য বিদেশী  লোকেরা থাকত ।  ওখানের    ব্যাবসায়িদের  বলে ইডেন ওয়ালা।“

“ওদের কোন বৈশিষ্ট্য আছে?” আমি একটু চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলাম।

“আছেই তো” উনি হেসে বললেন  ”আমরা মরুভুমির ইয়েমেনিদের মত, শত্রুকে একেবারে শেষ করে ফেলি, কোন সন্ধি করি না, কোন আপোষ করি না! No prisoners!  হা হা হা!

আমি বেশ চিন্তিত হয়ে গেলাম   এটা  শুনে।

যাকগে  , আফতাবের দোকান , ইন্ডিয়া কর্নার,   খোলা  হল খুব সাজিয়ে গুজিয়ে। ভেতরে আফতাবের প্রিয় হিন্দি সিনেমার গান  চলল সারাদিন। আমার বেশ পছন্দ হয়েচিল ইন্ডিয়া কর্নার,    জিনিষের  দামও  মোটামুটি কমের দিকে।

দুমাস ভালই চলল, তারপরে খদ্দের আসা খুব কমে গেল হটাত । আফতাব  খুব উদ্বিগ্ন হয়ে আমাকে ফোন করল।

“গৌতমদা , দোকানে কোন লোক নেই, মাছি তাড়াচ্ছে একেবারে। কি করি বলুন ত? “

আমি বললাম “ দেখ, একবার একটা  গুপ্তচর  পাঠিয়ে  দাও রুস্তমের  দোকানে , দামগুলো যাচাই করে আসুক।“

গুপ্তচরের রিপোর্ট  সুবিধার হল না। রুস্তমের দোকানে প্রায় সব কিছুর  দামই ১৫% থেকে ৪০% কম! ক্রেতারা কেন আর আফতাবের দোকানে  আসবে?

“শোন আফতাব” আমি বললাম বুঝিয়ে “ অনেক সময় পুরনো  বিক্রেতা  এই রকম দাম কমিয়ে দেয়। উদ্দেশ্য  হচ্ছে অন্যদের লোকসান  করিয়ে  দেওয়া, এইরকম কিছুদিন চললে নতুন বিক্রেতা লাল বাতি  জ্বালাবে । সমস্যা হচ্ছে যে নতুন বিক্রেতাও আবার দাম কমিয়ে দিতে পারে, তখন দুজনেরি রোজ  লোকসান হবে – যাকে বলে  দামের  যুদ্ধ লেগে যাবে। এরকম ব্যাবহারকে অর্থনীতিতে বলে  predatory -price -cutting. যদি আদি বিক্রেতার পকেটের জোর  বেশি থাকে, তাহলে  লোকসান সহ্য  করেও সে নতুনদের  দেউলিয়া করে দিতে পারে। তারপর সবাই চলে গেলে আদি বিক্রেতা আবার দাম বাড়িয়ে  দেবে, অনেক লাভ করবে।

যদি রুস্তমজি সত্যি এই খেলা খেলতে চায়, ওকে ঠেকানোর জন্যে অনেক কিছু  করতে পার। তুমিও দাম কমাবে কিন্তু একটা ম্যাক্সিমাম লোকসা্নের বেশি নেবেনা। আর দাম ছাড়াও অন্যভাবে খদ্দের আনার চেষ্টা কর। যাদের একটু চেন, তাদের স্পেশাল ডিসকাউনট  দেবে,  এমন সব মশলা  আর খাবার আনবে যা রুস্তমের দোকানে পাওয়া যায় না। সন্ধ্যেবেলা তোমার চাচিকে  বলবে  পাকোড়া ,  সামোসা এইসব একটু  করে দিতে,  খদ্দেরদের ফ্রীতে দিয়ে দেবে।

দেখবে কিছুদিন পরে রুস্তমজির মাথায় টনক নড়বে , তখন আস্তে আস্তে  দাম বাড়িয়ে  দেবে। অনেক খদ্দের আছে এই বাজারে, দুজন বিক্রেতা অনায়াসে টিকে  থাকতে পারে, যুদ্ধ করার কোন  কারন নেই।

কিন্তু  অর্থনীতিবিদ হিসাবে আমার বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যৎবাণী একেবারে মিথ্যা প্রমান হয়ে গেল। রুস্তমজি একেবারে নিষ্ঠুর   ইডেন ওয়ালার মত ব্যাবহার করলেন, আফতাবকে শেষ না করে ফেলা পর্যন্ত ওনার  শান্তি  রইল না। ছমাস ধরে সবকিছুর দাম একেবারে কমিয়ে রাখলেন রুস্তমজি, আফতাবের আর  কোন   আশা রইল না।  শেষ  পর্যন্ত দোকানের স্টক , আসবাবপত্র, সবই  জলের দরে বেচে দেওয়া হোল।

তৃতীয়  অধ্যায়ঃ আফতাবের বান্ধবী

ওমা, মাস দুই পরে চাচাজির ফোন ঃ  “ গৌতম স্যার, একটু আফতাবের সঙ্গে কথা বলুন । দোকান তুলে দেওয়ার পরে সব জিনিশপত্র, আসবাবপত্র বেচে দিয়ে প্রায় কুড়ি  হাজার ডলার হয়েছিল ( ষোল  লক্ষ টাকা)। আফতাবের  একাউনটে এই টাকা ছিল, ও সব টাকা নষ্ট করে দিচ্ছে ।

“সে কি! কি করছে কি?” আমি জানতে চাইলাম

“হামেশাই লাস ভেগাস  যাচ্ছে জুয়া খেলতে। আর  ক্যানসাসের বাডা বিং  ক্লাবে যাচ্ছে  প্রায় রোজই।“

“এই মরেছে! সর্বনাশ!” আমি তড়াক করে উঠে আফতাবকে ফোন  করলাম।

“ কি , চাকরিবাকরি পেয়েছ? কি করছ এখন?”

“না দাদা, এখনো সুবিধামত কিছু পাই নি, খুঁজছি ।“ আফতাব বলল ।

তুমি নাকি ভেগাসে যাচ্ছ জুয়া খেলতে?

“হ্যাঁ দাদা দুবার গিয়েছি, একবার আড়াই লক্ষ টাকা  জিতেছি আর একবার সাড়ে  তিন লক্ষ  টাকা হেরেছি  ব্ল্যাক জ্যাক খেলে। খেলতে আমার ভালই লাগে, কিন্তু এখান  থেকে প্লেনে  করে যেতে হয়, যেতে একদিন, আসতে  এক দিন – ও আমার পোষাবে  না , আর যাব না ঠিক করেছি।

“ আর তুমি নাকি বাডা বিং ক্লাবে যাচ্ছ রোজই”,

“হ্যাঁ, সপ্তাহে তিন চারদিন, বিরাট মজা। কালকে দুপুরে আমার সঙ্গে ওখানে চল, কথা হবে। “

এই ক্লাব, বাডা বিং, এর অনেক অন্য গল্প আছে আপনাদের পরে শোনাব , এখন খুব ছোট করে বলে দিচ্ছি। সহরের বাইরে  এটা  একটা স্ট্রিপ বার, মেয়েরা ষ্টেজের  ওপর  উঠে নাচে আর ওপরের জামা খুলে ফেলে সব।     স্টেজ থেকে নেমে মেয়েরা দর্শকদের  সঙ্গে মিশতে পারে, কিন্তু কোনরকম গায়ে হাত দেওয়া বারণ ।  কোনরকম  আর্থিক চুক্তি বা যৌন সঙ্গের  প্রস্তাব দেওয়াও বারন , যদিও গোপনে সবই  চলত।  দুজন দৈত্যের মত সিকিউরিটি গার্ড (bouncer) রেডি থাকত –  কেউ কিছু নিয়ম ভাঙলে হাসি হাসি মুখ করে তার পাশে এসে দাঁড়াত। সে কিছু

করার  আগেই  তাকে চ্যাংদোলা করে বারের বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিত। কোনোদিন     এদের মারপিট করতে দেখিনি!! দরকারই  হয়নি!

সন্ধ্যেবেলা ওই  বারে ভিড়  হয় ভাল, লোকে  মদ খেয়ে হুল্লোড়  করতে আসে।

 কিন্তু আমি আর আফতাব দুপুর  আড়াইটে   নাগাদ গেলাম ওখানে।  মোটামুটি  ফাঁকা , কয়েকটা মাতাল টেবিলে ধুকছে,  কয়েকটা লোক  মেয়ে পটাতে  এসেছে। আর দেখলাম কিছু পাগল উকিল আর  ব্যাবসায়ি  টেবিলে  বসে অফিসের কাজ করছে,  আর নাচ দেখছে আর বিয়ারও খাচ্ছে। মালটি – টাসকিং -এর একেবারে হদ্দমুদ্দ !!

মেয়েদের দেখলাম, সবাই  সাদা আমেরিকান মেয়ে, দুজন ছাড়া সবাইকেই সাধারন দেখতে, যদিও সকলেরি ফিগার ভাল । দুজন সুন্দরীর  মধ্যে একজনের কালো চুল, মুখ চোখ সাংঘাতিক  সুন্দর , আর একটু উদ্ধত মেজাজ সবসময়, নাম তার  সানিয়া , সেই আফতাবের  বান্ধবী ।

আমিও সানিয়াকে  দেখে মুগ্ধ !  আবার আফতাবের জন্য চিন্তাও হল।

“এ তো  বাংলায় যাকে বলে femme fatale , একে ম্যানেজ করছ কি করে “ আমি প্রশ্ন করলাম

“খুব টেনশন হচ্ছে দাদা। মেয়েটা সপ্তাহে দু তিন দিন সন্ধ্যেবেলা আমার ফ্ল্যাটে আসে। আমাদের  শারীরিক      সম্পর্ক  একেবারে ভল্ক্যানিক , প্যাসনেট , ফাটাফাটি ! কিন্তু ভবিষ্যতে কি হবে জানি না। “

“আমি আন্দাজ করতে    পারছি ।“  আমি বললাম “এর জন্য টাকা কিরকম খরচা করেছ? কিছু  বড় উপহার দিয়েছ? “

“হ্যাঁ দাদা, আমি তো একে না বলতে পারি না । একটা  পুরনো  গাড়ি  কিনে দিয়েছি , আর ওর  জন্মদিনে একটা  হিরের  আংটি  দিয়েছি , ক্যাশ  টাকাও  দিয়েছি  অনেকবার” ও স্বীকার করল

“ সর্বনাশ!  মনে হচ্ছে femme fatale শীঘ্রই ফুটবে, সাবধানে থেক”

এই কথা শুনে আফতাবের রাগ হয়ে গেল, সানিয়াকে নিয়ে একটা অন্য টেবিলে গিয়ে বসল । আমিও কিছুক্ষণ পরে বাড়ি চলে এলাম। চাচাজিকে  ফোন  করে সব বলে দিলাম। চাচাজি  খুব রেগে গিয়ে আফতাবের  একাউনটে  মোটে  আট লক্ষ টাকা পড়েছিল সেটা তুলে নেবেন বললেন। খুব রেগে গিয়ে গালাগালিও দিলেন

“কি কুলাঙ্গার ছেলে! ফ্যামিলির দেওয়া ব্যাবসার টাকা নিয়ে মেয়েদের হিরের আংটি কিনে দিচ্ছে!!  আর এক পয়সাও ওকে ব্যাবসার জন্য দেব না ভবিষ্যতে “।

চতুর্থ অধ্যায়ঃ প্রেম এবং বিবাহ

তারপরে ছয়মাস কোন খবর নেই। একদিন  ফোন  এল “দাদা, একটা  ব্যাংকে  চাকরি    পেয়েছি, টাকা পয়সা  মোটামুটি , সানিয়ার ভুত মাথা থেকে নেবেছে এতদিনে ।

“এবার সংসার করার কথা ভাবো” আমি বললাম।

“ হুম, চাচাজির ফ্যামিলি এখনো খুব চটে আছে,  আমার আমেরিকাবাসী দাদারাও চটে আছে । ওরা কেউ আমাকে সাহায্য করবেনা। আমি দেশে আমার মাকে বলেছি , আর এখানে ভারতীয় ম্যাগাজিন গুলোয় পাত্র পাত্রীর  বিজ্ঞাপন দেখছি । 

“খুব আস্তে আস্তে  এগোবে “ আমি বললাম। “ দরকার হলে আমাকে ফোন করবে।

কয়েকদিন পরে আফতাব খুব খুশী হয়ে আমাকে জানাল যে  নিউ ইয়র্ক সহরে এক  ভারতীয়  ঘটক (matchmaker) – এর  খবর  পেয়েছে, তারা ওকে  দশজন মেয়ের প্রোফাইল আর  ফোনের

খবর পাঠিয়ে  দিয়েছে , ভবিষ্যতে আরও  পাঠাবে !

একজনকে পছন্দ হোল আফতাবের, নাম তার সীমা , আমেরিকায় বড়   হয়েছে  বাঙালি মেয়ে, খুব কিউট দেখতে। আমাকে বলল, ওর সঙ্গে   রোজই    ফোনে  কথা হচ্ছে। আমি খুব খুশি হলাম।

সীমা থাকে  কলোরাডোতে, এখান থেকে প্রায় আটশ কিলোমিটার  দূরে ।   ফোনে , চিঠিতে একটা ছুইট প্রেম হচ্ছে খবর পেলাম, আফতাব বার দুয়েক গিয়ে সীমার  সঙ্গে দেখাও করে আসলো ।

ঝামেলা শুরু হয়ে গেল দুই ফামিলিকে নিয়ে। চাচাজি একেবারেই বাঙালি হিন্দু মেয়ের সঙ্গে আফতাবের বিয়েতে রাজি হলেন না, সীমার বাবা মাও মুসলিম ছেলের সঙ্গে বিয়েতে রাজি নয়।

আমি আফতাবের সঙ্গে দেখা করলাম।

“দেখ , তোমাদের  তিরিশের  ওপরে  বয়েস।  আমেরিকাতে সারা জীবন থাকবে। ফ্যামিলির মতামতকে কোন গুরুত্ব  দেবার দরকার নেই। নিজেরা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে কোরে নাও,  তোমাদের   দুজনের  কলেজের ডিগ্রি আছে দুজনেরি  গাড়ি  আছে , আফতাবের গ্রীন কারড  আছে আর সীমা  তো আমেরিকার নাগরিক। চাকরির বাজার  এখন  বেশ ভাল,  কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভাল চাকরি পেয়ে যাবে। তোমরা একটু দাঁড়িয়ে গেলে, তোমাদের বাবা মা ফ্যামিলি সব আবার ফিরে আসবে আমি কথা দিচ্ছি। 

আমি ওর  সঙ্গে গেলাম কলোরাডোর ডেনভার সহরে , রেজিস্ট্রি অফিসে ওদের  বিয়ে হল, আমি সাক্ষী দিলাম। ওরা একটা ছোট  ফ্ল্যাটে  চলে গেল, আমিও ফিরে এলাম।

ফোন এল কয়েকদিন পরে

“সব ঠিকঠাক , আফতাব?”

“হা স্যার সব ঠিক মত চলছে, কিন্তু  ভাল চাকরি এখনো পাই নি। একটা কথা বলব দাদা?”বলতে সংকোচ হচ্ছে।“

“কি ব্যাপার”?

“এই মানে আমাদের স্বামী -স্ত্রীর সম্পর্কটা  এখনো  পাকাপাকি  হয় নি”

“মানে”? আমি ত অবাক – তোমরা ত কয়েক মাস ধরে ডেট করেছ, তুমি বার তিনেক  সীমার সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছ, তাই না?”

“ঠিক। কিন্তু তখন তো সম্পর্ক  পুরো হয় নি , সীমা    বলেছিল বিয়ের পরে সব ঠিক  হয়ে যাবে। এখন বলছে আমরা আরও অপেক্ষা করব। আগে ভাল চাকরি  হবে, আর্থিক  সচ্ছলতা আসবে , তবে স্বামী -স্ত্রীর মত রিলেশন শুরু হবে, এখন আমরা এক বাড়িতে ভাই    বোনের মত থাকি।“

“কি কাণ্ড “ আমি তো  অবাক “ ও  তোমার   বিয়ে  করা বৌ  তো, এইসব আবার কি ঢং  বলতো।“

“কি করি বলুন ত?” আফতাব  খুব উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করল।

“আমি জানি না।  মনে হচ্ছে  এ বিয়ে নাও টিকতে পারে”।

তারপরের ঘটনা আফতাবের কাছ থেকে শোনা । কয়েক সপ্তাহ পরে একদিন দুপুরে হটাত  সীমার  মা চলে এলেন। বললেন নিজেই ঠিকানা  খুজে বের করেছেন (হতে পারে ওর  মেয়েই

ডেকেছিল) । মা মেয়েতে মুখোমুখি বসে একটু ফোঁস ফোঁস করল, তারপরেই মার অঝোরে কান্না, “আমার কাছে ফিরে আয়, খুকি, একি করছিস তুই”  এইসব বলে যাচ্ছেন, কান্না আর থামে না। তারপরে সীমা আর ওর  মা  দুজনকে জড়িয়ে ধরে আবার অনেক কান্না। শেষ  কালে সীমা ভেঙ্গে পড়লো,ঠিক  করল মার সঙ্গে বাড়ি  চলে যাবে।

“আই লাভ ইউ, আফতাব, কিন্তু আমার মা খুব কষ্ট পাচ্ছে, আমি সাত দিন মার সঙ্গে থাকি তারপর ফিরে আসব।“ এই বলে সীমা চলে গেল । তারপর প্রায় সাত সপ্তাহ হয়ে গেল সীমার আর দেখা নেই,  শুধু  মাঝে মাঝে গভীর  প্রেমের চিঠি আসে, তাতে নতুন সব প্রতিজ্ঞা থাকে।

সীমার  বাড়ির ফোনও বন্ধ হয়ে গেল। প্রায় তিন মাস অপেক্ষা  করে আফতাব ক্যানসাসে ফিরে এল চাচাজির কাছে।

পঞ্চম অধ্যায়ঃ হায়দ্রাবাদ

এই অংশটা কিন্তু একেবারে  অপ্রত্যাশিত ।

ক্যানসাসে আফতাব ভীষণ  ভাবে ডিপ্রেসনে ভুগতে সুরু করল,  ডাক্তাররা বললেন  ও  সুইসাইড  করার চেষ্টা  করতে পারে। চাচাজি ওকে জোর কোরে দেশে পাঠিয়ে  দিলেন।

হায়দ্রাবাদে তখন সবে  outsourcing এর   কোম্পানিগুলো  খুলতে শুরু করেছে , বিসনেস, অর্থনীতি , কমপিউটার , এইসব যারা জানে তাদের    ভীষণ  চাহিদা । আফতাবকে জোর করে  চাকরির  ইন্টার্ ভিউতে পাঠান হোল। ওমা, একটা ছোট আই টি কম্পানি ওকে HR বিভাগে সহকারী ম্যানেজার -এর পদে কাজ দিলো।

আফতাবের মন  তখনো খূব খারাপ ।

আমার সংগে ফোনে কথা  হোলো

“গৌতমদা, কাজ একটা পেয়েছি। আমাকে কিছু  কম্ বয়েসি আই টির লোকেদের  ম্যানেজার করে দিয়েছে। ওদের সঙ্গে কাজ করতে ভালই লাগছে। কিন্তু সীমাকে বড় মিস করছি। কি করে ওকে এখানে নিয়ে আসা যায় বলুন তো? “

আমি আর ওকে বেশী  ঘাটাইনি। ওর  বাড়ির লোক অনেক আছে , তারাই ওকে শান্ত  করবে। 

নব্বই এর দশকের শেষে  হায়দ্রাবাদের ভীষণ  উন্নতি হল  খুব কম সময়ের মধ্যেই ।

নতুন অনেক টেক কম্পানি খুলে গেল, নতুন টেক সহর তৈরি হল, চব্বিশ ঘণ্টা  সেখানে অফিসে  কাজ হয়, গাড়ি , বাস, ট্যাক্সি  চলে, রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে , একদম জমজমাট  ব্যাপার ।

আফতাবের কম্পানি সারা পৃথিবীতে ওদের সফট ওয়ার বিক্রি করতে শুরু করল।  আকারে বেড়ে গেল প্রায় কুড়ি গুন ।

আফতাবকে বিরাট  চাকরি দেওয়া হোল HR বিভাগে। ছয়  বছরের মধ্যে আফতাবের জীবন বদলে গেল একেবারে।

 আমার সঙ্গে ফোনে কথা হল ওইসময়

“ খুব ভাল আছি দাদা, বাড়ির  লোক  সম্বন্ধ করে একটা কমবয়সী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে , বাচ্ছা হবে ছমাস পরে। চাকরিতে মাইনে খুবই ভাল  আর আমার সহকর্মীরাও ভীষণ  সাহায্য করে।“

আমি বললাম

“Congratulations! Looks like you turned your life around! I am very happy for you!”

“থ্যাংক ইউ দাদা। আমি এখানেই থেকে যাব  এখন।“ আফতাব বলল ,

“জানেন একটা  বিরাট আফসোস হয় খুব। কেন অত  টাকা খরচা করে আমেরিকায় গিয়েছিলাম? কিছুই ত হলনা,  যাই করতে গিয়েছি, তাতেই বিরাট  গণ্ডগোল  হয়েছে, আমার দুর্দশা, আমার ফামিলির দুর্ভোগ , সব কিছুই ফর নাথিং। আমেরিকায় যাওয়ার কোন  দরকারই  ছিল না।

“ঠিক বলেছ” আমি উত্তর দিলাম “ তোমার ক্ষেত্রে এটা একদম সত্যি। তা  তোমার গ্রীন কারড তো  এখনও ভ্যালিড আছে, একবার আমেরিকায় বেড়াতে  এস। আমি তোমাদের শিকাগো বেড়াতে     নিয়ে যাব গাড়ি  করে”

“ আর একবার রুস্তমের দোকানে  যাবে নাকি”? আমি প্রশ্ন করলাম

“হা হা হা, অবশ্যই যাব,  ওকে ধন্যবাদ দিতে হবে আমার ব্যাবসা লাটে  তুলে দেওয়ার জন্যে “ আফতাব উত্তর দিল।

হুনার ক্যাপ্টেন জুনিয়র যশ

হুনার  ক্যাপ্টেন জুনিয়র যশ

কানসাস -এ আমার বন্ধু ছিল  যশুয়া , ডাক  নাম যশ । না,  গবেষক  নয়, অধ্যাপক নয় , আমার প্রতিবেশি, স্থানীয় পাওয়ার প্ল্যান্টে ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করত।  

আমাদের  আড্ডা ভালই জমত, বিয়ার আর স্ন্যাকস নিয়ে বসা হোতো প্রতি  শনিবারে ।  যশুয়া  বা যশ একেবারে টিপিকাল শ্রমজীবী  আমেরিকান,  পড়াশোনা বেশিদূর করে নি, ওই হাই স্কুল পর্যন্ত।    হাই স্কুলেই যশ ওর ক্লাসের  মেয়ে এমির  প্রেমে একেবারে হাবুডুবু। এমিও লটকে গেল, তারপর   দুজনেরি ১৮ বছর বয়েসে  বিয়ে হোল ।  পরপর দুটো বাচ্ছা হয়, বড়টার নাম ছোট (জুনিয়র)  যশ আর ওর ছোট বোনের      নাম  মেরী ।

এই গল্পটা ছোট  যশের জীবন নিয়ে, প্রায় পঁচিশ বছরের ঘটনা ।

যখন ছোট যশের বয়েস  আঠেরো, আমার বয়েস ৩২ আর ওর বাবার বয়েস ৩৭। ওর বাবা ওর সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরন করতে শুরু করল ওই বয়েসেই । বাবা আর ছেলে একসঙ্গে বিয়ার আর সিগারেট খেত, আমিও ওদের  সঙ্গে হামেশাই যোগ দিতাম। যশ ছিল ইলেকট্রিক মিস্তিরি , কিন্তু কত রকম  মেরামতির কাজ যে ও করতে পারত তার ঠিক  নেই – কলের মিস্তিরি, রাজমিস্তিরি,  বাগানের মালী , গাড়ির মেকানিক, – সব কাজের  যন্ত্রপাতিতে  ওর গ্যারাজ  ভর্তি। ছেলেকে সব আস্তে আস্তে শেখাতে শুরু করেছিল  যশ।

ছোট যশের মুখটা একেবারে ছোট ছেলের মতন, দেখে মনেই হয় না ওর ১৮ বছর বয়েস। ওর বয়েসি মেয়েরা ওকে একবারেই পাত্তা দিত না , তাই কয়েক    মাসের মধ্যেই খোকা যশ মুখভরতি দাড়ি আর গোঁফ গজিয়ে ফেলল।    এতে করে ওর অনেক বান্ধবী হল কিনা জানিনা, কিন্তু ওর মুখ দেখে আমার হাসি পেত – ঠিক  মনে হত বাচ্চা ছেলের  মুখে আঠা দিয়ে দাড়ি গোঁফ লাগান হয়েছে।

হাতের কাজ, মিস্তিরির কাজ এসব তো  হোল , তা পড়াশোনার কি হবে? আমরা একদিন মীটিং করলাম, যশ, এমি, ছোট  যশ এবং আমি। সেই প্রথম দেখলাম আমেরিকান বাবা মারা ছেলেকে কিরকম  স্বাধীনতা দেয়।

খোকা যশ বলে, কলেজে  পড়বে না, কোন ইচ্ছে নেই

“তাহলে চাকরি খোঁজ , বাড়িতে  বসে থাকবি নাকি?”  ওর  বাবা বলল।

“বাবা, আমি আমেরিকান পুজিপতিদের  পকেট ভারি করার জন্য  জন্মাই নি। প্রাইভেট সেকটর ফ্যাকটরি  বা অফিসে  কাজ করব না কোনদিন।“  খোকার কি তেজ!

“আর কোনদিন পরিবেশের (environment) দূষণ (pollution) হয়, এরকম কাজ আমি করব না।“ খোকা আমাদের জানাল।

সেদিন এই  পর্যন্ত । মাস খানেক পরে যশ আমাকে জানাল “খোকা প্ল্যান করেছে”!

“সত্যি? কি করতে চায়?”

“একটা ডিপ্লোমা করা যায় ক্রিমিনাল অ্যান্ড লিগাল স্টাডিস , আঠেরো মাস লাগে। ওটাই করবে বলছে।“ যশ জানাল আমাকে। “পুলিশ, নিরাপত্তা রক্ষী, সমাজসেবক, উকিলের সহকারী, এইসব চাকরি হতে পারে।“

“দেখ কি হয়” আমি বললাম “তোমরা ছেলেমেয়েদের  বড় বেশি স্বাধীনতা দাও। আমার ছেলে হলে হাত পা বেঁধে কলেজে পাঠিয়ে দিতাম হাহা!!”

“খোকা তো তবু পড়বে বলেছে ! আমার ষোলো বছরের মেয়ে বলছে  চিড়িয়াখানায়

পশুপক্ষীর সেবা করেই জীবন কাটিয়ে দেবে!!”

‘কি সর্বনাশ! ধরে মারো সব কটাকে, নইলে ঠিক  হবে না!”

এরপরে প্রায় দুই বছর কেটে গেছে। ডিপ্লোমা   শেষ করার পর ছোট  যশ আর ওর বাবা বুঝতে পারল, ওই ডিপ্লোমা দিয়ে বড় শহরে পুলিশের চাকরি হবে না। বড় শহরের পুলিশের  চাকরি পেতে হলে  ক্রিমিনাল সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রি লাগবে, খুব নামকরা শহরে পুলিশের চাকরি পেতে হলে   আবার পুলিশ অ্যাকাডেমিতে ট্রেনিং  নিতে হবে।   আর, দাড়িগোঁফও বোধ হয় কাটতে হবে।

চাকরির খোঁজে বেরিয়ে পড়ল যশ একটা পুরনো গাড়ি নিয়ে, আর বাবার কাছ থেকে কিছু  টাকা ধার করে।  প্রায়  তিন বছর আমেরিকার ছোট শহরগুলোতে ঘুরে বেড়াল ছোট যশ । আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে যেখানে কম লোক  থাকে  সেখানে ছোট ছোট সব শহর আছে যাদের লোকসংখ্যা দশ হাজারের  থেকে  কম।  সেই সব সহরে  ঘুরে ঘুরে  চাকরির চেষ্টা   চলতে  লাগল ।

 পয়সার অভাব ছিল, অর গাড়িটাও পুরনো , তাই বাবা মাকে দেখার জন্য ক্যানসাসে ফেরে নি বেশিবার। ফোনে  কথা হতো  বাবা মার সঙ্গে, আমার সঙ্গেও হতো মাঝে মাঝে।

ওর ছোট শহরের  অভিজ্ঞতা  খুব একটা সুখের নয়। একবার ফোনে বলল “টেক্সাস প্রদেশে এল সেগুনডো বলে একটা ছোট শহরে পুলিশের কাজ পেলাম কাকু, কিন্ত পুলিশ চিফ মহা শয়তান। মোটে  পাচজন  পুলিশ, সবাইকে চাকরের মতো খাটায়। ওর বাজার করা , বাড়ি সারান,ছেলেমে্যেকে দেখা , এমনকি গাড়ি ধুয়ে পালিশ করা পর্যন্ত সব আমার দায়িত্ব । আমি তিনমাস কাজ করে পালিয়েছি! “

আরেকবার বলল “ নেভাডা প্রদেশের একটা গ্রামে সমাজসেবকের কাজ পেয়েছিলাম। বস একজন বয়স্কা মহিলা, সে সুযোগ পেলেই আমার গায় হাত বুলায়, আর প্রায়ই বলে আমার বাড়িতে   রাতে চলে এস , খুব মজা হবে।

“আমি পালিয়েছি খুব তাড়াতাড়ি !”

আমার খুব হাসি পেল  বললাম “ জিগোলো যশ! ইয়া বেবি!!”

 আরেকটা জায়গায় কাজ পেল, সেখানে একটা কম্পানি কয়েক হাজার বড় গাছ কেটে  দিয়েছে “ওখানে থাকলে আমার খুব ডিপ্রেশন হবে কাকু। ওই কাজও ছেড়ে দিলাম।“

শেষ পর্যন্ত , বাবার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করল, সুদূর  আলাস্কা প্রদেশে যাবে চাকরি খুজতে। চাকরিও হবে আবার অ্যাডভেঞ্চারও হবে। বাবা যশ  ফাইনাল নোটিস দিয়ে দিল ছেলেকে – “আলাস্কাতে কাজ না হলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবে, কলেজে ঢুকবে । কাকুর কাছে অর্থনীতির    ক্লাস করবে!”

প্রথমে যশ গেল আলাস্কার দক্ষিন পশ্চিমে, যেখানটাকে ইনসাইড প্যাসেজ   বলা হয়।

আলাস্কার পশ্চিমদিকটা  একেবারে অসাধারন। সমুদ্রের ধারেই বিশাল পাহাড়ের দেয়াল। সেখানে জলপ্রপাত, বরফের গ্লেসিয়ার, আর পাইন  গাছের জঙ্গলে হরিন, মুস, ভালুক, বীভার, আরও কত জীবজন্তু। আর সমুদ্রে তিমিমাছ, সিলমাছ, ওআলরাস , অরকা হাঙ্গর আর ডলফিন। লেক আর নদীতে, স্যালমন, trout, bass,  আরও কত  মাছ!

 প্রকৃতি দুই হাত ভরে দিয়েছেন ওখানে। কিন্তু পূর্ব  দিক থেকে যেখানে আলাস্কা এবং ক্যানাডার মেন ল্যান্ড , সেখান থেকে   বিশাল পাহাড়  আর জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে  আসার   কোন রাস্তা নেই।

এখানে সব ছোট ছোট শহর (গ্রাম!) আছে –

অদ্ভুত   সব নাম – জুনো, কেচিকান, স্ক্যাগওয়ে , হুনা, মেটলাকাতলা, হাইডাবারগ, এই সব।  হয় নৌকো করে নয় প্লেন -এ করে যেতে হয়, গাড়ি  যাবার কোন  রাস্তা নেই, রেলগাড়িও নেই । শুধু   মৎস্যজীবীরা  এখানে থাকে, কোন কোন গ্রামে হয়ত একটা  মাছের  processing / canning এর কারখানা আছে। সম্প্রতি যে শহর  গুলোতে  বড়  এবং গভীর  বন্দর আছে, সেখানে  বিশাল সব  cruise ship আসতে শুরু করেছে, টুরিস্টরা আসায় তাদের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে।  কিন্তু   হুনাতে  বড়  জাহাজ যায়  না।

হুনার লোক সংখ্যা ৯৩১ ( কলকাতায় আমাদের পাড়াতেই হাজারখানেক লোক থাকে)।

আর  ভীষণ  ভীষণ ঠাণ্ডা, শীতকালে মাইনাস ৪০/৪৫ সেন্টিগ্রেড হামেশাই হয়। শীতকাল নয়মাস ধরে চলে, আর  গরমকালে শুধু বৃষ্টি , আর ৮/১০ ডিগ্রি তাপমাত্রা!

ছোট যশ এই হুনাতে পুলিশ অফিসারের চাকরি পেল, মুখভরতি দাড়িগোঁফ নিয়েই।

একটু গুছিয়ে  নেওয়ার পরে বাবাকে নিমন্ত্রণ  করল, আমাকেও  ফোন করলো একদিন সকালে,

“কাকু আমি যশ  বলছি”

“আরে তুই তো এখন পুলিশ অফিসার হয়ে  গেছিস !! কিরকম লাগছে?” আমি বললাম।

“ফাটাফাটি কাকু! আমি তো ডেপুটি চিফ, আমার বস হচ্ছে চিফ, আর আমাদের সঙ্গে দুজন রুকি (নভিস)  অফিসার আছে,  চারজনের পুলিশ বাহিনী হুনাতে!”

“ ও বাবা ! বিশাল পুলিশের দল দেখছি তোদের! তা  কাজের চাপ কিরকম?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম

“কিছুই না” যশ  বলল “ সপ্তাহের শেষে একটু  মাতলামি করে লোকে । অধিকাংশ লোকই ইনুইত (যাদের আগে এস্কিমো বলত), ওদের মধ্যে ড্রাগের চলন নেই, যদিও মদটা ওরা খায় খুব। শোনো , বাবা আসছে পরের মাসে, তুমিও চলে এস। “

আমি বললাম “ওরে বাবা, প্লেনে করে যাব না একদম। পাঁচটা প্লেনে চড়তে হবে ক্যানসাস সিটি থেকে। শেষ প্লেনটা আবার সিক্স- সিটার । উঠেই আমার মাথা ঘুরে যাবে!

“কাকু, আলাস্কা ফেরীর নাম শুনেছ?  সিয়াটল থেকে ছাড়ে , সমস্ত ছোট  শহরগুলোতে বুড়ি  ছুঁয়ে যায় “

“ওতে যেতে তিন দিন লেগে যাবে। এখন  আর যাব  না যশ, গরমের ছুটিতে  দেখা যাবে।

হুনা শহরটা কিন্তু খুব একটা ভাল দেখতে নয়। দুটো তিনটে পাকা রাস্তা, দুটো ট্রাফিক লাইট। একটা একতলা স্কুল  বাড়ি আর একটা সিটি অফিস, আর কোর্ট আর পুলিসের থানা আরেকটা   বাড়ির মধ্যে।  কিছু বড় গুদমঘর আর  কিছু  ছোট দোকান – এই সব। দুটো রাস্তা আছে  শহর থেকে সমুদ্রে যাওয়ার জন্য। একটা চলে যায় বন্দরে যেখানে মাছের নৌকা আর  জাহাজ আসে, আর একটা উলটো দিকে সমুদ্রের ধারে চলে যায় , সেখানে  একটা  ছোট  ডক আছে , প্রাইভেট নৌকা   সেখান থেকে ছাড়ে । ও ,একটা হসপিটালও আছে শহরে , আর দু তিনটে গ্রসারি/সুপারমারকেট। নিরাশ হবেন না শহরের বর্ণনা শুনে, একটু     চোখ  তুলে পশ্ছিম দিকে তাকালেই অকুল সমুদ্র, আর পূর্বদিকে তাকালে পাইন গাছের জঙ্গল আর  বিশাল বরফের পাহাড় , আকাশে গোল্ডেন ইগল পাখি ঘুরছে, জায়গাটা ভালই!

প্রায় সত্তর শতাংশ অধিবাসী হচ্ছে  ইনুইত, বাকিরা সাদা আমেরিকান। না, কেউ আজকাল ইগ্লুতে থাকে না, সবাইকার ছোট  ছোট  বাড়ি  আছে, তিন কোনা ছাত বাড়িগুলোর । কিছু   লোক আবার  ট্রেলার হোমে  থাকে,  আলুমিনিয়ামের চৌকো বাড়ি, চাকা লাগান, ওগুলো  দেখতে  খুব বাজে।

গরিব কেউ না, কিন্তু  কারুরই বেশী পয়সা নেই। সরকারি চাকরি  বা মাছ সঙ্ক্রান্ত ব্যাবসা, এই করেই চলে আর কি। তিন মাস গভীর  শীতের  সময় মৎস্যজীবীরা নৌকো নিয়ে বেরোতে পারে না। প্রায় সকলেরি  ATV (all terrain vehicle) আছে, যেগুলো তিন চাকা গাড়ি,    মোটা মোটা চাকা লাগানো , এগুলো  নিয়ে জঙ্গলে যায় বা বরফ জমা সমুদ্রের ওপরে  চলে যায়। আর, প্রত্যেক বাড়িতেই  মস্ত বড়  freezer আছে, সেখানে গরমকালের ধরা  অনেক কিলো মাছ আর হরিন বা গরুর মাংস জমানো থাকে শীতকালে  খাওয়ার জন্য।

হুনা সহরের একই  পাড়ায় দুটো ছেলে ছিল – ম্যাক্স আর  নীল । ম্যাক্স  নীলের থেকে  বয়সে প্রায় চার বছরের বড় , কিন্তু ম্যাক্স   প্রতিবন্ধী , ওর  মাইলড অটিসম ছিল। অটিসম যাদের  থাকে তারা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না, সিরিয়াস অটিসম থাকলে কথা বলতেও শেখেনা, দেয়ালের দিকে  মুখ করে বসে থাকে। মাক্সের অটিসম অত খারাপ ছিল না।

 বেশি  বয়েসে ম্যাক্স  হাই স্কুলে পড়ত নীলের  সঙ্গে,  একই ক্লাসে । ম্যাক্স -এর ব্যাবহার এমনিতে  স্বাভাবিক , শুধু সব কিছুই আস্তে আস্তে করত, আর লোকের সঙ্গে কথা বলতে চাইত না। লোকের মুখের দিকে চেয়ে কথা বলতে পারত না। উত্তেজিত হয়ে গেলে ভীষণ চেঁচাত, আরও বেশি রাগ হলে হাতের কাছে যা পেতো তাই ছুঁড়ে মারত।  

হাই স্কুলের কয়েক বছর  পরে নীল  হুনাতে রুকি ( শিক্ষানবিস)  পুলিশের চাকরি পেল।

পুলিশের গাড়ি , সাইরেন, বন্দুক, টেসার গান (taser, এগুলোকে stungun বলে, লোককে     অবশ এবং   অকেজো করে দেওয়া যায় ) পুলিশের ওআকি টকি  রেডিও, আবার পুলিশ বডি

  ক্যামেরা – যত নতুন খেলনা!  নীল খুব খুশী। খুব উৎসাহের সঙ্গে হুনার রাস্তায় টহল দেয় গাড়ি  নিয়ে – আইন রক্ষা করতে হবে না! মাঝে মাঝে চেনাশোনা বয়স্ক লোককে রাস্তায় দাঁড়  করায়,  একটু গল্প করে, বলে “সাবধানে গাড়ি চালাবেন কাকু”। 

সুন্দরী ১৬/১৭ বছরের মেয়েরা, যারা  সবে গাড়ি চালাতে শিখেছে , তাদের দেখলে নীল গাড়ির সাইরেন বাজিয়ে দাঁড় করাত। মাঝে মাঝে তাদের লাইসেন্স চেক করত আর প্রচুর প্রশ্ন করত। মেয়েরা পুলিশ চিফের কাছে কমপ্লেন করার পরে  এটা  একদম  বন্ধ করে দিতে হোল – হায় হায়!

ওর বন্ধু ম্যাক্স একটা কাঠের গোলায় চাকরি পেল। কাজ খুব সাধারন, ঠেলাগাড়ি  করে কাঠ  নিয়ে যাওয়া , লরি থেকে মাল নামান ওঠানো ,  করাত দিয়ে কাঠ কাটা এইসব আর কি।

বেচারি ম্যাক্স-এর পেছনে নীল খুব লাগত হাই স্কুলে পড়ার সময়   থেকেই ।, হাঁদা বলে ডাকতো , গালাগাল দিত,, ওর বান্ধবী নেই বলে আওয়াজ দিত – এইসব ! নীল পুলিশের চাকরি পাওয়ার পরে এই হ্যারাসমেনট আরও বেড়ে যায় । কিন্তু কেউই ভাবে নি নীল আর মাক্সের ঝগড়ার এইরকম সাংঘাতিক পরিনতি হবে।

কি ঘটেছিল আমি নিজের চোখে দেখিনি। একদিন বিকেলবেলা ছোট যশ খুব উত্তেজিত হয়ে ওর বাবাকে ফোন করে। আমাকেও সেইদিন রাতে  ফোনে সব কথা বলে দেয়।

ঘটনাটা ঘটে শনিবার সকালে। তার আগেরদিন, শুক্রবারের সন্ধ্যায়, মাক্সের দুটো কুকুর প্রচণ্ড ঝগড়া আর মারপিট  করতে শুরু করে।  দুটোই হিংস্র পিট বুল কুকুর, শেষ পর্যন্ত একটা কুকুর মারা যায় ।       প্রচণ্ড কুকুরের চিৎকার আর  মাক্সের বাড়ির লোকেদের  চিৎকার , পাড়ার লোকেরা  পুলিশ দেকে দেয় । নীল সাইরেন বাজিয়ে ওর  গাড়ি  নিয়ে আসে, তারপর ম্যাক্সকে খুব গালাগাল দেয়, বলে নিজের কুকুরদের সামলাতে পারিস না বোকাচো —-।  শান্তিভঙ্গের জন্য, হিংস্র জন্তু বাড়িতে  রাখার জন্য, আরও কিসব  অজুহাতে, অনেক টাকা  ফাইন -এর নোটিস  ধরিয়ে  দেয় ম্যাক্সের হাতে। মাক্সের খুব রাগ হয়ে যায় , কিন্তু ও চুপ করে থাকে

পরের  দিন, শনিবার , মাক্স কাঠগোলায়  কাজ করতে যায় সকালে। একটা বড় লরিতে করে কাঠ ডেলিভারি দিয়ে ড্রাইভার চলে গেছে। মাক্স লরিটাকে নিজেই চালিয়ে দোকানের সামনে নিয়ে আসে।  একটা ছোট ফর্ক লিফট  ট্রাকে করে লরি থেকে মাল নামাচ্ছে। এমন সময়   নীল এসে গেল সাইরেন বাজিয়ে আর ভীষণ হুজ্জুতি শুরু করে দিল। প্রথমেই বলল লরিটা ভুল জায়গায় পার্ক করা  হয়েছে তার জন্য   জরিমানা হবে কারন লরিটা বড় রাস্তার ট্রাফিক   আটকে  দিচ্ছে।  তারপর বলল ফর্ক লিফট   ট্রাকটা রাস্তার ওপর পার্ক করা হয়েছে তার জন্য জরিমানা হবে, আর হ্যাঁ যত কাঠ নামান হয়েছে লরি থেকে, সেগুলো ফুটপাতের ওপরে রাখা হয়েছে, তার জন্যও ফাইন দিতে হবে।

আর সমানে মাক্সকে গালি দিচ্ছিল  নীল ।

“দ্যাখ গাড়োল , তোর একদিনের কাজের ফাইন দিতে  তোর সাতদিনের মাইনে খরচা হয়ে যাবে হাহা”

ভাগ্য ভাল, যে এর একটু  আগেই নীল ব্যাক আপ -এর জন্য  ফোন  করে, যশ  ওর গাড়ি  নিয়ে সাইরেন বাজিয়ে চলে আসে।

যশ গাড়ি থেক নামার আগেই হটাত ম্যাক্স ভীষণ খেপে গিয়ে ওর নিজের গাড়ির দিকে ছুটে  গেল। নিমেশের মধ্যে একটা  শট গান নিয়ে এসে নীলকে গুলিকরে। নীলও সঙ্গে সঙ্গেই ওর টেসার   গান  ছুঁড়ে মাক্সকে    অবশ  করে দেয়।

যশ গাড়ি থেকে নেমে দেখে, মাক্স যন্ত্রণায়  ছটফট  করছে, মুখ দিয়ে ফেনা  বেরচ্ছে। আর নীল ডান  হাতের ওপরের দিকটা  ধরে বসে আছে, খুব রক্ত বেরচ্ছে ।

মাক্সএর স্নায়বিক আঘাত লেগেছিল এই টেসার থেকে,, কয়েক সপ্তাহ হাস্পাতালে ছিল।   নীলের গুলির আঘাত খুব একটা  খারাপ হয় নি, ওকে  দুদিন বাদে  হাস্পাতাল থেকে ছেড়ে  দেয়। 

ঘটনাটা ঘটে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যে, কিন্তু এর ফল হল সাঙ্ঘাতিক।  আমেরিকা মহা

মাম্ লাবাজ দেশ আর এই ঘটনায় লাইন দিয়ে উকিলরা এসে  গেল।  হুনা শহর, হুনার পুলিশ কর্তৃপক্ষ, মাক্সের পরিবার, নীল, আর জুনিয়র যশ, সবাই একে অপরকে নানা কারনে অভিযুক্ত  করে দিল। মাক্সের পরিবার হুনা সহরের, পুলিশের, নীলের আর যশের  বিরুদ্ধে মামলা করল পুলিশ brutality-র  অভিযোগে , আবার নীলের পরিবার  মাক্সের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার (attempted murder)  অভিযোগ  আনল। 

 হুনার শহর আর পুলিশের  বিরুদ্ধে নীল আর যশ  অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করার মামলা আনল কারন ঘটনার পরেই পুলিশ চিফ নীল আর যশকে সাসপেন্ড করে দেয়।  আরও একাধিক মামলা হল এইসব নিয়ে, আমার অত মনে নেই।  জজ সাহেবের হুকুমে প্রথমে ফৌজদারি মামলার নিস্পত্তি  হল, তারপর অন্য কেসগুলোর শুনানি শুরু হল।

 ওই সময় আমাদের যশ খুব কষ্টে কাটিয়েছে ।  চাকরি চলে গেছে, হুনার স্কুলে সিকিউরিটি গার্ডের পারট  টাইম  কাজ করে, জমান টাকা আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আলাস্কা প্রদেশের সরকার একটা বেকার ভাতা দিত, সেটা  নিয়ে কোনরকমে চলে যেত।

আমি   ফোনে  একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, “অনেক হয়েছে, এখন বাবা মা্র কাছে চলে এস না কেন?”

“অনেক মামলা একসঙ্গে চলছে কাকু” যশ  জানাল , “আমি একমাত্র আই উইটনেস , তাই সব  মামলাতেই আমার সাক্ষী দেওয়া ম্যানডেটরি , না গেলে পুলিশে ধরে জেলে রেখে দেবে।     ক্যানসাসে  ফিরে যাওয়া এখন সম্ভব নয়।“

“মামলাগুলো সব চুকে গেলে এখানে  চলে আসবে তো” আমি প্রশ্ন করলাম।

“বলা যায়না  কাকু” যশ  আমাকে জানাল  “  হুনাতে আমার উকিলের অফিসে এক সহকারী (প্যারালিগাল)  কাজ করে, আমি ওকে বলি প্যারালিগাল প্রিনসেস ।  মেয়েটিকে  আমার খুব পছন্দ।

“এই মরেচে” আমি হাসতে  হাসতে  বললাম “ উকিলের অফিসে এইসব কি হচ্ছে কি?”

“এখনও কিছু হয় নি কাকু, ক্রমশ প্রকাশ্য”

তা প্রায় দুবছর লেগে গেল সব মামলা চুকতে । তারপর একদিন যশের  ফোন এল

“ কাকু, সব কেস চুকে গেছে, আমি বেক্সুর খালাস, , আর হুনা সহর আমাকে গত দবছরের মাইনে, আর একটা থোক টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে!”

আমি ত শুনে খুব খুশি । বললাম “ ভাল করে সিনিয়র যশের সঙ্গে পরামর্শ কর এখন  কি করবে। গাঁজা খেও না বেশি!”

“কে কাকে বলছে? তুমি তো রোজই খেতে। আজকাল কমিয়েছ?” যশ আমাকে খোঁচা মারল। তারপর বলল “ আমার এক নতুন অ্যাডভাইসার   হয়েছে,  প্যারালিগাল প্রিনসেস -এর বাবা। “

ওর সঙ্গে ব্যাবসায় নামব  ওই ক্ষতি পূরণের টাকা নিয়ে।

এই কথা হয়ার  কিছুদিন  পরে ইন্টারনেটে একটা নোটিস  দিল যশ সব সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে।

            RIDE THE INUIT PRINCESS (BOAT)

            LEAVES FROM THE BEAUTIFUL PORT OF HOONAH, ALASKA

            THE BEST WHALEWATCHING TRIPS IN ALASKA

            WHALE SIGHTING GUARANTEED OR YOUR MONEY  BACK

            CALL CAPTAIN JOSH JUNIOR : XXX-XXX-XXXX

WHALEWATCHING আমেরিকায় খুব জনপ্রিয়, যশ এইসব শুরু করে দিল নাকি? আমি উত্তেজিত হয়ে ওকে ফোন করলাম।

“কি সব হচ্ছে কি?”

“বলছি সব” যশ বলল “আমার বান্ধবীর বাবা আর আমি একটা নৌকো কিনেছি। নৌকোর ডেকের  ওপর  দশ পনের জন লোক  বসতে  পারে,  তা ছাড়াও বিশ্রাম  করার  দুটো  ঘর আছে  , একটা রেস্ট রুম আছে, একটা মিনি কিচেন আছে। আমেরিকায় আনেক বড়লোক   আছে, তারা অপরিচিত অজানা জায়গায় যেতে  চায়, তাদের নিয়ে তিমিমাছের পাল দেখতে যাব । আমার পার্টনার এখানে বহুদিন নৌকো চালিয়েছে, ও সব গোপন  জায়গা  জানে যেখানে বড় জাহাজ যেতে পারেনা, সেখানে পাঁচ দশটা  বা কখনো এমনকি তিরিশ চল্লিশটা  হাম্পব্যাক হোয়েল একসঙ্গে খেলা করে, মেলামেশা করে। বড় লরির সাইজের অনেক তিমিমাছ একসঙ্গে  জল থেকে লাফাচ্ছে, ছবি নিশ্চই দেখেছ,। একবার  দেখলে আর ভোলা যায় না।

পয়সাওয়ালা  আমেরিকানরা এইরকম বোট ভাড়া করে  এডভেনচার করতে চায়, অনেক টাকা  দিতে রাজি থাকে আর খুশি হলে অনেক টাকা  টিপস দেয় । সপ্তাহে তিন চারটে  ভাড়া  পেলেই আমার চলে যাবে ভালভাবে, হাতে অনেক জমেও যাবে ।  শীতকালে ওই  জমান টাকা  দিয়েই চলবে , দরকার হলে  প্যারালিগালের ঘাড়ে চেপে খাব হাহা।“

“ভাল প্লান হয়েছে” আমি বললাম। “বাবা কি বলে”?

“বাবা আসছে শীঘ্রই  , খুব উত্তেজিত এইসব শুনে”

“আমিও আসার চেষ্টা করব?” আমি বললাম।

  তারপরে আর     যাওয়া হয় নি। কিন্তু খবর পাই  ছোট যশ  এখন বড় ক্যাপ্টেন হয়েছে, ব্যাবসা ভালই চলছে। ভাবা যায় না, পুরনো  গাড়ি নিয়ে যে কাজের খোঁজে সারা দেশ ঘুরে বেড়াতো ,  তার এইরকম অবস্থা   হবে।

পরিশ্রমের কাজ, অনেক ঝামেলা আছে, অনেক রিস্কও নিতে হয় মাঝে মাঝে।  ছোট যশের  বয়েস প্রায় চল্লিশ হল, কিন্তু এই বয়েসেই দাড়ি সব পেকে গেছে। হাসিটা কিন্তু  সেই  ছোটবেলার  মতই আছে।

প্যারালিগাল প্রিন্সেসের সাথে বিয়ের ঠিক হয়েছে। আমার  আর পাপা যশের নেমত্তন্ন। সিয়াটল শহর থেকে  ফেরী বোটে করে যাব, যেতে তিন দিন লাগবে। আর বিয়ের পরে ছোট  যশের  সঙ্গে 

WHALEWATCHING করতে যাব !

এই সুযোগ  ছাড়লে চলবেনা !

ডুলুথে প্রাতরাশ

ডুলুথে  প্রাতরাশ

আমেরিকার উত্তরে লেক সুপিরিয়র। খুব ছোট  লেক নয়। এই ১৫০০ কিলোমিটার লম্বা আর ১৫০০ কিলোমিটার  চওড়া , মোটামুটি ওটা একটা সমুদ্র। অ্যাটলান্টিক মহাসাগর থেকে বিশাল সব জাহাজ চলে আসে , আমেরিকার গম, কয়লা, লোহা এসব  নিয়ে যায় । ডুলুথ  সহরটা   এই লেকের ধারে, খুব গভীর এক  বন্দর আছে এখানে।  ছোট্ট  সহরের ধারে দৈত্যের মত   বড়  বড় জাহাজ পার্ক করা থাকে, বন্দরের ধারে রাক্ষসের  খেলনার মতো মস্ত সব পাইপে করে জাহাজে মাল তোলা  আর নামান হয়। কয়লার  পাহাড়, গমের পাহাড় তৈরি হয়ে যায় বন্দরের পাশে।

মধ্য আমেরিকার অর্থনীতিক থিয়োরি গ্রুপের  কনফারেন্স করতাম আমরা বছরে দুবার। নিউ ইয়র্ক , ক্যালিফোর্নিয়া , এইসব জায়গায় বড় সব কনফারেন্স হয়, প্রচুর ভিড়  হয়ে যায়। নামকরা সব  অর্থনীতিবিদরা  আসে,   আমাদের মত চুনোপুঁটিদের  আবস্থা কাহিল হয়ে পড়ে।

সুতরাং আমরা ছোট সহরে এই  বাচ্ছা  কনফারেন্স করতাম যেখানে আমাদের গবেষণা  নিয়ে   নির্ভয়ে অনেক  কথা বলা যায় । এক এক  বার এক  একটা  সহরে হতো । ২০০৩ সালে হয়েছিলো ডুলুথ সহরে।

সহরের মাঝখানে সব প্রশাসনিক এরিয়া আছে, সেখানে বড় বড়  সব হোটেল  আছে, সেখানেই  ডুলুথ হিলটন হোটেলে আমাদের মিটিং হচ্ছে। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই  ওই  আধুনিক বড়  হোটেলে  ঘর  নিলাম না।  

বন্দরের প্রধান চ্যানেলের ধারে পুরনো কিছু পাথরের বাড়ি । কতকগুলো বন্দরের অফিস, কতকগুলোকে নিয়ে একটা শপিং মল খোলা  হয়েছে , আর একটা পুরনো পাথরের বাড়িতে উনবিংশ শতাব্দীর একটা হোটেলকে সংস্কার করে একটা আধুনিক “বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট”  খোলা হয়েছে , সেখানেই আমি একটা ঘর নিলাম। ঘর খুব ছোট, আসবাবপত্র একশো বছরের  পুরনো , দেওয়ালে  পুরনো দিনের জাহাজের আর বন্দরের ছবি, গোল গোল  জানলা জাহাজের মত।

শুক্রবার সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে, কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ডুলুথের হিলটন হোটেলে পৌঁছলাম । সেখানে সারা বিকেল মিটিং করে, সন্ধ্যেবেলা   চ্যানেলের ধারে আমার হোটেলে  ঢুকলাম । লবিতে দেখি সমিধবাবু দাঁড়িয়ে  আছেন ।

সমিধ বাবু পড়ান নেব্রাস্কা প্রদেশের  একটা বড়  কলেজে। ওনার গবেষণার জন্য উনি অনেক উঁচু লেভেলের অংক করে অর্থনৈতিক  সমস্যার বিশ্লেষণ করেন। আমি খুব সম্মান করি ওনাকে, কিন্তু ওনার  অংক  অনেক সময়েই ভাল বুঝিনা। সব সময়ই ওনার  মন  নিজের কাজের মধ্যে ডুবে থাকে, তাই এই   হোটেলে  ওকে দেখে বেশ অবাক হলাম।

“ কিরকম আছেন সমিধবাবু? আপনি হিলটন হোটেলে  থাকছেন না?”

ঊনি একটু দুঃখের সঙ্গে বললেন “ না, তাড়াতাড়ির মধ্যে ঘর রিসারভ  করতে ভুলে গিয়েছি, এখন সকলের থেকে দূরে এই  বাজে হোটেলে  থাকতে হবে, কি ঝামেলা বলুন ত?”

“হিলটনে আমার সহ-লেখক , সহ- গবেষক সবাই আসছে, ওদের  সঙ্গে কাল সকালের আগে দেখা হবে না – সময়টা একেবারে নষ্ট হোল। “

“এখান থেকে বন্দরে জাহাজের আনাগোনা দেখা যায় , আজ রাতে ওই দেখেই সময় কাটিয়ে  দিন না? আমি বললাম।

“ না না, এখন সময় নেই, পরের সপ্তাহে দুটো নতুন পেপারের  সারসংক্ষেপ জমা দিতে হবে। আমি  ঠিক করলাম  যে এখনই  হিলটন হোটেলে  ফিরে যাব  , আমার সহ লেখকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। রাতে এখানে ঘুমাতে আসব।“ ওনাকে  খুব  ব্যাস্ত মনে হল।

“ঠিক  আছে “  আমি বললাম “ এখানে সকালে ফ্রী  ব্রেকফাস্ট দেবে, মনে করে খেয়ে  যাবেন ।  হিলটন হোটেলে এক কাপ কফির দামই  পড়বে  ৪০০ টাকা।

উনি চলে যাবার পরে দেখলাম সন্ধ্যে সাতটা বাজে। এখানে রাত সাড়ে  নটা পর্যন্ত সূর্যের আলো থাকে গরমকালে। চমৎকার আবহাওয়া। হোটেলের লবিতে মালিকের সঙ্গে আলাপ হোল । না,

গুজরাটি  প্যাটেল নয়, এনার নাম সেরগে, রাশিয়া থেকে আসা অভিবাসী (immigrant).  । বেশ বড় চেহারার  লোক,  ভারি রাশিয়ান  একসেন্টে    ইংরাজি বলেন , শুনলে ভয় ভয় করে। উনি বললেন লবির এক কোণে একটা মিটিং রুম আছে, সেখানে প্রাতরাশ দেওয়া শুরু হবে সকাল সাড়ে  সাতটা থেকে।

হোটেলের  পাশেই শপিং মল । যখন অটোমেশন হয় নি, জাহাজের ডকে অনেক লোক  কাজ করত মাল  তোলা  আর নামানর জন্য, এখানেই তারা কাজ করত। এখন আমেরিকান পুঁজিপতিরা এর চেহারা বদলে দিয়েছে। গিফট শপ, সুভেনির  শপ, টয় শপ, আর তার সঙ্গে জামার দোকান , জুতোর দোকান , আরও  কত কি!!  আর হারবার উইংস বার, হারবার পিজ্জা, হারবার  চিকেন, হারবার ক্যান্ডি  – মাথা খারাপ হবার জোগাড়।  মোটে দুটো পুরনো দোকান  দেখলাম, একতলায় একটা দুশ বছরের পুরনো  কাঁচা মাছের দোকান, সামনেই লেক, সেখান থেকে সোরডফিশ, পারচ, সোল, ব্যাস এইসব ধরে বিক্রি হচ্ছে, একেবারে ফ্রেশ! আর দোতলায় একটা বহু পুরনো রেস্টুরেন্ট , সেখানে শুধু মাছভাজা আর আলুভাজা বিক্রি হয়।  সাংঘাতিক ভাল  ভেটকির   (sea bass) ফ্রাই  খেলাম ওখানে।

তিনতলায় একটা জাহাজের মিউসিয়াম আছে, পুরনো  জাহাজের অনেক যন্ত্রপাতি রাখা, অনেক বাচ্ছা সেখানে ভিড়  করেছে, মিউসিয়ামের সামনেই  একটা  বড় টেরাস, সেখান থেকে চ্যানেলে জাহাজ আসা দেখা যায় – একদম সামনে থেকে, মনে হয় হাত দিয়ে জাহাজগুলোকে ছোঁয়া যাবে।  চ্যানেল প্রায় ১০০ ফুট চওড়া , কিন্তু জাহাজ প্রায় ৮০ ফুট চওড়া, আর আমরা ৩০ ফুট  দূর থেকে দেখছি , আমাদের নাকের পাশে দশ তলা উঁচু জাহাজ চলে যাচ্ছে । আধুনিক জাহাজগুলোয় লোক নেই একবারে,  সেই অনেক উচুতে ব্রিজের ওপর ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে  আর একজন কর্মচারী  ডেকের ওপর  স্প্রে  দিয়ে পরিস্কার  করছে।

আমরা , বাচ্ছা এবং  বড়রা অনেক  ক্ষণ ধরে  টেরাস থেকে জাহাজ দেখলাম,  আবার হোটেলের  ঘরে  গিয়ে দেখলাম জানলা দিয়ে দিব্বি জাহাজ দেখা যাচ্ছে ।  রাত্রি দশটার  পরে সব অন্ধকার হয়ে গেল, দুর্ঘটনা যাতে  না হয় সেজন্যে অত বড় সব  জাহাজ  সব আলো জ্বালিয়ে দিল বন্দরে ঢোকার  সময়, দেখতে সাংঘাতিক লাগছিল, কিন্তু   এত  উজ্জল  আলো  যে রাতে শোবার সময়  জানলা বন্ধ করে পরদা টেনে  দিতে হল। 

পরের দিন সকালে উঠে ঠিক  করলাম আজকে মোটে ফাঁকি  দেব না,  তাড়াতাড়ি  চানটান    করে সোজা  চলে গেলাম  প্রাতরাশের ঘরে। ওমা, ফ্রি বলে একেবারে বেসিক ব্যাবস্থা, ডিম  নেই বেকন  নেই , প্যানকেক নেই, ফলও নেই! একটা  টেবিলে  সাদা স্লাইস ব্রেড, কয়েক প্যাকেট কর্ণফ্লেক ,টি ব্যাগ , আর গুঁড়ো কফি, আর দুধ।

 কম বয়সী  এক দম্পতি  ছিল  প্রাতরাশের  তত্তাবধানে , চেহারা দেখে মেক্সিকান মনে হল।  সেনর (ভদ্রলোক )  আমি যাওয়া  মাত্রই  লাফ দিয়ে একটা বড়  ব্যাগ নিয়ে এল

“সরি স্যার, আমার সাপ্লাই সব শেষ হয়ে গেছে, বাজার থেকে ফল, কেক, জুস, এইসব নিয়ে আসছি এক্ষুনি

এই বলে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে প্রায় ছুটে  পালিয়ে গেল।

ঘরে আমি আর  সেনোরা। ভাল করে দেখলাম, মেয়েটাকে খুব সুন্দর দেখতে, বেশি লম্বা নয়,  কিন্তু  বয়েস কম, ফিগার একেবারে ফাটাফাটি । একটা পাতলা কাপড়ের     ডীপ  ভি-নেক ব্লাউস পরেছে , আর টাইট জীনস , তার জন্য খুবই যাকে বলে, বুঝতেই পারছেন হি হি !!

একটু গল্প করতে ইচ্ছা তো হোলই । কিন্তু গোড়াতেই গণ্ডগোল – সেনোরা একবর্ণ ইংরাজি বলতে পারে না। যাই বলি না কেন, শুধু সি সি বলে আর সুন্দর হাসি দেয়।

হুম, প্রাতরাশের কি হবে? সেনোরা     টেবিলের ধারেই  দাঁড়িয়ে আছে । ওই  ত আমাদের খাবার দেবে, কিন্তু কি করে বুঝবে আমি কি চাই?

প্রথমে ভাবলাম , ইশারা  করে দেখিয়ে  দোবো, কিন্তু  তাতে ঠিক হবে না মনে হোল।  

মনে মনে দুর্গা দুর্গা বলে চলে গেলাম টেবিলের ধারে, সেনোরার  উল্টো    দিকে।  চোখ  বড় বড় করে উনি আমাকে না না বললেন অনেক বার, আরও কত কি বললেন স্প্যানিশ ভাষায় রাগ করে! একদম  পাত্তা না দিয়ে আমি  পাউরুটির প্যাকেট খুলে  দুটো  স্লাইস  টোস্ট করতে দিলাম, একটা কর্ণফ্লেকের প্যাকেট খুললাম, আর  গরম জলের কেটলিতে জল গরম করে কফি করে নিলাম। ব্যাস, প্রাতরাস হয়ে গেল। সেনোরা হাসি বন্ধ করে দিয়ে রাগ রাগ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, , আমি ফিক ফিক করে  হাসতে হাসতে সব খাবার খেয়ে নিলাম।

খাবার পরে একটু চ্যানেলের ধারে ঘুরে এলাম, এই পনেরো কুড়ি  মিনিট  হবে। ফিরে এসেই লবিতে  সমিধ বাবুর সঙ্গে দেখা। ভীষণ উত্তেজিত!

“গুড মর্নিং”, আমি বললাম , “ খেয়েছেন সকালে?”

“ কি বলব মশাই” উনি বললেন” প্রাতরাশের ঘরটাতে একটি  মেয়ে কাজ করে, একদম অকর্মণ্য। আমার একটু  ক্লরেসটেরল বেশি আছে, তাই আমি  ওই মেয়েকে বললাম একটা লাইট হুইট ব্রেড টোস্ট করে দাও, আর স্কিম মিল্ক আর গ্রীন টি দাও। ও শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল আর বিদেশি ভাষায় কি সব বলতে লাগল। যত সব !!”

“সে কি?” আমি বললাম “ আমি তো  নিজেই ব্রেকফাস্ট বানিয়ে  খেয়ে নিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। ওই মেয়েটার  বর  তো  দশ মিনিট  পরেই ফিরে আসার কথা ছিল , সে ভালই ইংরাজি বলে।“

“তা আমি জানিনা, আমার ভীষণ রাগ হয়ে গেল, আমি সোজা গিয়ে ফ্রন্ট ডেস্কে ওর  নামে কমপ্লেন করে দিলাম” উনি খুবই  রেগে আছেন মনে হল।

“ফ্রন্ট ডেস্কে কে ছিল ? একটা রাশিয়ান লোক ? সেরগে?” আমি প্রশ্ন করলাম।

এই কথার পরেই শুনলাম ফ্রন্ট ডেস্কের সামনে থেকে খুব চ্যাঁচামেচি। গিয়ে দেখি,  সেনর আর অর বউ সেরগের কাছে ক্ষমা চাইছে , সেনর সবে বাজার থেকে ফিরেছে , হাতে  প্রাতরাশের খাবারের থলে।

সেরগের মুখ রাগে লাল, ইংরাজি আর রাশিয়ান দুই ভাষায় অনেক গালি দিলেন সেনরকে। শেষকালে বললেন” তোমাদের এখানে আর কাজ করার দরকার নেই, বেরিয়ে যাও এখান  থেকে এই মুহূর্তে।“

সেনর মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে দরজার দিকে হাঁটতে সুরু করল, তার পাশেই  সেনোরা একদম ছোট মেয়ের মতো অঝোরে কান্না শুরু করে দিল। প্রচুর অশ্রুপাত হল, ওর  জামার সামনেটা ভিজে গিয়েছিলো একেবারে। আমরা অবাক হয়ে  চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখলাম।

ওরাও চলে গেল, আমরাও যে যার আলাদা গাড়ি  চালিয়ে হিলটন হোটেলে চলে গেলাম।   শনিবার সারাদিন কনফারেনস হল। রবিবার সকালে, আমার হোটেলের প্রাতরাশের   ঘরে তালা বন্ধ,  কি আর করা যাবে, হিলটন হোটেলে গিয়ে ৪০০ টাকার  কফি আর ১৫০০ টাকার টোস্ট  আর ডিম ভাজা  খাওয়া হোল – যত শালা চোর !সকালে দুঘন্টা একটা ফেয়ারওয়েল সেশন হোল, ভাল ভাল সব স্পিচ শুনে সবাই গাড়ি চালিয়ে  বাড়ি চলে এলাম।

আসার সময় আর একবার সমিধবাবুর সঙ্গে কথা হোল । “ওই  প্রাতরাশের লোকগুলোকে   ছাড়িয়ে   দিল কেন বলুনতো?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“কে জানে, ওরা  অবৈধ  নাগরিক বোধ হয়,  চোরও হতে পারে। যতো সব বিদেশী অশিক্ষিত লোক! “ উনি নিজের কমপ্লেনের কথা ভুলেই গিয়েছেন  দেখলাম।  বোঝো!

আমিও খুব একটা ভাল লোক  নই। ওই  দম্পতির জন্য আমার দুঃখ একেবারে হল না। শুধু সেনোরা যখন  কাঁদছিল , প্রচুর অশ্রুপাতের  ফলে ওর  পাতলা  জামার সামনেটা কিরকম ভিজে গিয়েছিল  ভি-নেক যে কিরকম আকর্ষণীয় দেখাচ্ছিল , সেই নিয়েই চিন্তা  করছিলাম গাড়ি  চালিয়ে বাড়ি  আসার পথে।  

আমেরিকা আর পুঁজিবাদী  অর্থনীতি  আমাদের বদলে দিয়েছে ।

অনেক বস্তা অনুভূতিপ্রবণতা (sensitivity) নিয়ে ইন্ডিয়াতে বড়  হয়েছি। সে সব কোথায়  গেল?

হেরা দেবীর অভিশাপ

This is a work of fiction. Any resemblance between this story or its characters and events or characters in real life is purely coincidental and unintentional.

হেরা দেবীর অভিশাপ

 গ্রীস দেশের পৌরাণিক ইতিহাসে অনেক দেবতার গল্প আছে। যিউস হচ্ছেন দেবতাদের রাজা আর হেরা ওর রাণী। কিন্তু রাজা যিউসের একটু চরিত্রের দোষ ছিল অনেকদিন ধরেই, কম বয়েসি দেবী আর হুরীদের সঙ্গে অনেক রকম ব্যাপার চলত । হেরা যখন মধ্যবয়েসে পৌঁছলেন, তখন তার এইসব আর সহ্য হত না।   অভিশাপ দিতে শুরু করলেন  যিউসের প্রেমিকাদের । এরপরে হেরার নাম হয়ে গেল  ঈর্ষার দেবী।

ঈর্ষার খপ্পরে আমরা সবাই পড়েছি, বেশি আর কম। কিন্তু আমার সহকর্মী নিলাদ্রি ঈর্ষার বশে হেরা দেবীর মত আভিশাপ দিয়েছিল একজনকে ।

কার    ওপর  হিংসা হয়েছিল খুলে বলছি। লোকটার নাম  অশোক, ,  সেই শাপ ফলতে লেগেছিল প্রায় চল্লিশ বছর!

আমি যখন ক্যানসাস উনিভারসটিতে পড়াতে শুরু করি, সে অনেকদিন আগের কথা, তখন অশোক ওখানে ফলিত রসায়ন  বিভাগে (Applied Chemistry) পি এইচ ডি  করছিল। আমরা থাকতাম  একটা ছোট শহরে , আমেরিকার মাঝখানে, যেখানে ভারতীয় খুব কম ছিল, আর বাঙালি তো হাতে গোনা কয়েকজন মোটে।  আমার আবার ওই কম বয়েসে একটু অহংকার ছিল, অশোককে খুব একটা পছন্দ ছিল না। আর গনিতের অধ্যাপক   নিলাদ্রি বাবুর নাক আরো উঁচু ছিল, উনি অশোককে একেবারে পছন্দ করতেন না।

কিন্তু বেচারি অশোকের  কি দোষ? আমি কোনদিন  নিলাদ্রিকে অশোকের  দোষের ফর্দ  দিতে বলিনি, তবে উনি  বিভিন্ন সময় যা সব মন্তব্য করতেন তা নিয়েই একটা বড় লিস্টি হয়ে যেত ঃ

“আরে ফলিত রসায়ন   আবার একটা সাবজেক্ট নাকি? শুধু  অশোকের মতো  কেলানে লোকেরাই  ওইসব পড়তে  আসে !”

“অশোকবাবুর ভুঁড়িটা দেখেছেন ? বাচ্ছা হবে নাকি?”

“জুলফির সাইজটা দেখেছেন? ষাটের  দশকের পরে আর কেউ ওরকম জুলফি রাখে নাকি?”

“অশোক কি কিপটে  রে বাবা! এক পয়সা খরচা করতে চায় না!”

“অশোক কি পরনিন্দে করে  লোকের  পেছনে! ছি ছি!!”

“আমরা মশাই আগেকার দিনের  প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছি, অশোকের সঙ্গে একটা তফাৎ

তো  আছেই, একটু কথা বললেই সেটা  প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাই না? কোন পড়াশোনা নেই ,কালচার নেই যা তা একেবারে!”

এইসব সুন্দর  সব মন্তব্যের ওপর আমি আর কথা বলতে চাই না, শুধু  কিপটেমির কথাটা একেবারে ঠিক!

অশোক আমাকে একবার  নেমত্তন্ন করে  শুধু মুরগির ডানা  আর  গলার  ঝোল খাইয়েছিল,  ওগুলো আমেরিকায় কেউ খায় না,  জলের দামে বিক্রি হয়!

কিন্তু ঈর্ষা ? অশোক  তখন  ছাত্র, আয়ও খুবই কম, সুতরাং কেউ ওর প্রতি  ঈর্ষা করেনি।

অশোকের থিসিস যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তখন ও ছুটি নিয়ে একবার ইন্ডিয়া গেল দুমাসের  জন্যে। জনগণের মধ্যে খুব গুজব রটতে শুরু হোল যে  অশোকের বাড়ি  থেকে ওর বিয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে ।

গুজবটা ঠিকই  রটেছিল , অশোক  ক্যানসাসে ফিরে  এলো  তনুশ্রীকে    নিয়ে।

তনুশ্রীকে দেখে  সব দেশী  ছেলেদের চোখ  গোল হয়ে গেল!! কি সুন্দর  মুখ আর হাসি!! আর চেহারাটা  মশাই বাংলায় যাকে বলে ভলাপচুয়াস!  আর ব্যাবহার  একেবারে চার্মিং , সবসময় হাসি খুশি।

আমরা পুরুষ মানুষেরা মোটামুটি  সবাই  তনুশ্রীকে দেখেই  কুপোকাত !  আমাদের বৌদের আবার হিংসে  যেমন হল, তেমন      আবার  মজাও হোল, অশোকের  মত কেলানে ছেলের সঙ্গে  তনুশ্রীর  বিয়ে হয়েছে দেখে।

সত্যি কথা বলতে কি, সম্বন্ধ করা বিয়েতে অনেক সময়  ভীষণ  অমিল হয়, এটা  তারই   একটা  চরম কেস বলতে হবে আর কি!!

আমাদের নিলাদ্রি বাবু  কিন্তু ,  এক বিদুষী পদার্থ বিজ্ঞানী মহিলা, কেরালার মেয়ে, তার সংগে অনেকদিন  মিশে বাবা মার অমতে তাকে বিয়ে করেছিলেন।  ওনার কিন্তু অশোক আর তনুশ্রীর বিয়ে একেবারেই পছন্দ হয়ে নি।

“দেখবেন, এই বিয়ে  টিকবেনা !  ওই    সুন্দর মেয়ে কি করে এই মোটা  রাক্ষসের সঙ্গে থাকবে? এ একেবারে বাঁদরের  গলায় মুক্তোর  মালা ! আমি বলছি, অশোকের  বিবাহিত  জীবনে বেধড়ক   বিপর্যয় হতে বাধ্য।“

  • এইসব বলে  উনি ভবিষ্যৎ বাণী   করলেন ,  আরও     কিসব বলেছিলেন রাগ করে, আমার মনে নেই!!

যাকগে, শাপ তো দেওয়া হোল,  কিন্তু  অশোক বহাল তবিয়তে  পি এইচ ডি  শেষ করে দিলো,  আবার গবেষকের চাকরি পেল অনেক দূরের শহরে,  আমরা ওদের  ফেয়ারওয়েল  পার্টি দিলাম মজা করে, যদিও নিলাদ্রিবাবু আসতে পারেন নি অনেক কাজ ছিল!!

অনেকদিন তারপর কেটে গেছে। প্রায় পনেরো  বছর। অশোকের সঙ্গে হটাত ক্যানসাস সিটির একটা দোকানে দেখা । অশোকের  চেহারা আরও ফুলেছে,  আর তনুশ্রীর চেহারা লাবণ্যে ঝলমল করছে।

খুব ভালই আছে ওরা, তাই মনে হোল।  অশোক  পনের বছর অন্য জায়গায় চাকরি করে তারপর ক্যানসাসের একটা ছোট কলেজে বিরাট  চাকরি নিয়ে এসেছে।

ওদের  সংগে নতুন করে যোগাযোগ হল। অশোক খুব ভাল করেছে, অনেক গবেষণায় সফল হয়েছে, অনেক টাকার  গ্রান্ট পেয়েছে  শুনলাম।

  আমাদের এরিয়ায় গ্রান্ট খুবই কম টাকার হয়, একমাস পড়ানোর টাকা, বা কিছু বই কেনার টাকা , বা কনফারেন্সে যাবার টাকা – এইসব আর কি। অশোকের গ্রান্ট শুনলাম     বারো  লক্ষ  ডলার!! অতো টাকা কিসের জন্য? খোঁজ নিয়ে জানলাম  গ্রান্ট  সম্বন্ধে অনেক কিছু।

এই বারো  লক্ষ  ডলার একটা  সরকারী সংস্থা  অশোকের বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়েছে , অশোকের কানের অসুখের ওষুধ বার করার গবেষণা  করার জন্য । এই টাকা দিয়ে ও নিজের  গাড়ি বাড়ি  কিনতে পারবেনা, কিন্তু অন্য প্রচুর সুবিধে পাবে । ওর  বিশ্ববিদ্যালয় এই টাকার  একটা  বড়  অংশ নিয়ে নেবে  overhead

এর জন্য। তাহলেও  বাকি টাকা থেকে ও নিজের পছন্দ মতো  অনেকজন  গবেষক নিয়োগ  করতে পারবে ওর ল্যাবের জন্যে। ল্যাবের যন্ত্রপাতি কিনতে পারবে, ওর অফিসের  জন্য যা  দরকার কিনতে পারবে। তাছাড়াও ওই কানের ইনফেকসনের সংক্রান্ত যত  কনফারেন্স হবে, সব জায়গায় অশোক নিজের সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে যেতে  পারবে। এছাড়াও দরকার মত বই, গবেষণামূলক পত্রিকা, কমপিউটার, এমন  কি  অফিসের আসবাবপত্র   সবই ওই  গ্রান্ট  থেকে এসে যাবে । সব থেকে interesting হচ্ছে যে  ওই  গ্রান্টের টাকা থেকেই ওর উনিভারসিটিকে ওর  নিজের বেতনের অর্ধেক ফেরত দিয়ে দিতে পারে, তা হলে ওকে অর্ধেক ক্লাস পড়াতে  হবে না, সেই সময়টা গবেষণার দিকে লাগাতে পারবে। ওর  নিজের বেতনও কমবে না!!

এইসব বড় গ্রান্ট  পেলে অনেক পণ্ডিতেরই মাথাটা একটু গুলিয়ে   যায়, অশোকের বেলায় ও তার ব্যাতিক্রম  হল না।   নামকরা উনিভারসিটিতে অনেকজন বড় গ্রান্ট পাওয়া অধ্যাপক থাকেন , ফলে কেউ খুব একটা লাঠি  ঘোরাতে পারে না । কিন্তু অশোক একটা    ছোট  উনিভারসিটিতে  ডিপার্টমেন্টের চেয়ারমান হয়ে ঢুকল অত বড় গ্রানট নিয়ে। ওর বস, যে না কি  ওখানকার ডীন , সে  ওর কথায় ওঠে বসে (প্রতি বছর ওভারহেডের টাকা ডীনের কাছে চলে যায়,  ডীন উপাচার্যকে দেখায় এতো  টাকা গবেষণার  জন্য আনা হয়েছে!) অন্য অধ্যাপক্ রা যাদের কারও ওরকম বড়  গ্রান্ট নেই, সবাই অশোকের কাছে কেঁচো হয়ে থাকে। ডিপার্টমেন্টের অন্যতম অংশ হচ্ছে স্নাতকোত্তর গবেষকরা , যারা ল্যাবে সারাদিন কাজ করে। প্রায় জনা পনের  গবেষকের মধ্যে বারো জনই অশোকের গ্রান্টের টাকায় আনা, অধিকাংশই তার মধ্যে ইন্ডিয়া থেকে, অশোক দেশে গিয়ে খুঁজে খুঁজে এদের নিয়ে আসত। এরা অশোকের টাকা থেকে মাইনে পাবে, অশোকের প্রোজেক্ট  নিয়ে গবেষণা করবে, আর কাজ শেষ হয়ে গেলে  অশোকের সুপারিশে অন্য জায়গায় কাজ পাবে,এইরকম ব্যাবস্থা ছিল।  বলাই বাহুল্য যে ওরা অশোককে দেবতার মত ভক্তি করতো।

অশোকের ডিপার্টমেন্টের সাম্রাজ্যের কথা তো  শুনলেন , বাড়িতেও ওর  প্রতাপ ছিল খুব। শহরে বেশ কিছু বাঙালি ছিল, ওদের ক্লাবের নাম ছিল বসন্ত। অশোকের চেষ্টায় বসন্তের মিটিং -এর জায়গা ওর প্রাসাদোপম বাড়িতেই  হবে ঠিক হল। প্রতি শনি/রবিবারে জনা পনের লোক ওর বাড়িতে জমায়েত  হতো।  হয় ক্রিকেট , নয় ভারতীয় গানের ভিডিও, বা  ভারতীয় সিনেমা বা ডকুমেন্টারি অশোকের  বাড়ির

বেসমেনটের বিশাল  ঘরে দেখান হত। 

অশোকের  বউ  তনুশ্রী  প্রায়  প্রতি সপ্তাহেই ১৫/১৬ জন লোকের  জন্য নিজের হাতে রান্না করত, হয় বিরিয়ানি, চিকেন টিক্কা , নয় বাঙালি শুক্ত,  মাছের কালিয়া, এই সব।

মাঝে মাঝে বড়  মিটিং  ডাকা হত, প্ল্যান করার জন্য। প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ জন লোক ছেলেমেয়ে নিয়ে

জড় হত ওই  বিশাল ঘরে। বাড়ির পেছনে এক একরের বিরাট লন, সেখানে বাচ্ছারা খেলতে যেত, আর বড়রা ভবিষ্যতের অনুষ্ঠান গুলো অরগানাইস করত – দুর্গা পুজো,  সরস্বতী  পুজো ,   দিওয়ালী, দোল ,

নববর্ষ, পিকনিক, স্পোর্টস,  সংগীত সম্মেলন, আরও কত কি!  হল ভাড়া, চাঁদা তোলা, কলকাতা থেকে শিল্পিদের নিয়ে আসা , অনুষ্ঠান পরিচালকদের ম্যানেজ করা,  এইসব প্লান অশোক এবং   ওর সাঙ্গোপাঙ্গরা যত্ন নিয়ে তৈরি করতো , বসন্তের সবাই সেগুলো  অ্যাপ্রুভ করত   আলোচনা  করে।

তনুশ্রীর জবাব নেই, এক হাতে পঞ্চাশ জন লোকের  লুচি আলুর দম , বা ফিশ ফ্রাই  বানিয়ে দিত, সঙ্গে  মিষ্টি  আর চা!!

সাংস্কৃতিক সম্মেলনে শিল্পি যোগাড় করায় অশোকের দক্ষতা ছিল সত্যিই  অনস্বীকার্য , অনেকদিন আগে একবছর দিওয়ালিতে  সন্ধ্যা মুখারজিকে  নিয়ে এল, আমরা দুই ঘণ্টা ধরে  ওনার গান শুনলাম। আর একবার শ্রেয়া ঘোষালকে নিয়ে এল, যদিও  ওনার বয়েস অনেক কম ছিল  তখন, কিন্তু গলা সাংঘাতিক।

বাড়িতে “বসন্তের” সাম্রাজ্য, অফিসে গ্রানটের সাম্রাজ্য  । প্রায় দশ বছর ধরে   অশোকের আমেরিকায় আসা ১০০%  সার্থক হয়েছিল –তার পর এদিক ওদিকে ছোট ছোট  গণ্ডগোল  হতে শুরু করে। আমরা কোনদিন ভাবি নি  ব্যাপারটা  এতদূর  গড়াবে।

দশ বছরে অশোকের অহংকার বেড়েছিল খুব, ওর  অনুষ্ঠানের কিছু  একটা ব্যাপার নিয়ে কেউ কমপ্লেন করলেই  ও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠত। অফিসে অন্য অধ্যাপকদের তাচ্ছিল্য করত, অনেকে খুব অপমানিত হতেন।

কিন্তু মুল গণ্ডগোল  হোল ওর গবেষক  ছাত্রদের নিয়ে।  ওরা বরাবরি   আসত অশোকের “বসন্ত” মিটিংগুলোতে , যদিও  অধিকাংশই বাঙালি নয়। অশোকের স্বেচ্ছাচারিতা  যখন বেড়ে গেলো , তখন এদের ওপর হুকুম করা শুরু হোল। প্রতি মিটিং -এর সময় এদের খাবার পরিবেশন করা আর ডিস ধোয়ার কাজ দেওয়া হোল।  বাড়ির পেছনের বড় লনের ঘাস ওদের কাটতে  বলা হোল।   এমন কি  এক বছর খুব বৃষ্টি হয়ে, ওর মিটিং -এর বড় ঘরটা জলে ভরতি হয়ে গিয়েছিল, গবেষকরা  বালতি আর মগ নিয়ে সব  নোংরা জল বার করে দিয়েছিল।

ওই গবেষকরা বাচ্চা ছেলে নয়, এরা post-doc , প্রায় সকলের‍ি পি এইচ ডি আছে। এরা সবাই অসম্মানিত হলেও অশোকের  ভয়ে  মুখ বন্ধ করে রইল। এমন কি,   তনুশ্রীর  লোভনীয় বিরিয়ানি আর চিকেন টিক্কাও দক্ষিণ  ভারতীয় গবেশকদের মোটেই পছন্দ হল না,  কারন   ওরা সবাই তো নিরামিশ খেত শুধু!

এইভাবেই চলত, কিন্তু ২০০৫ সাল নাগাদ ডঃ বিভীষণ গুপ্ত অশোকের ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন, বাঙালি হিসেবে বসন্তেও যোগ দিলেন। তারপরই সব বদলে গেল।

প্রথম পাঁচ বছর উনি চুপচাপ, তারপরে চাকরি পাকা হয়ে গেল আর উনি  অশোকের  বিরুদ্ধে মুখ খুললেন। ডিপার্টমেন্টের সভায় অশোকের নামে দুটো অভিযোগ পেশ করা হোল ঃ প্রথমত, অশোক গবেষকদের গবেষণার  রেসালট  প্রাইভেট   কম্পানির কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে অনেক কোটি টাকা  দিয়ে।

দ্বিতীয়ত, অশোক গবেষকদের ওর  ব্যাক্তিগত কাজে ওর বাড়িতে  নিয়ে যাচ্ছে ।

অশোকই ডিপার্টমেন্টের কর্তা , ফলে এই  অভিযোগ সব এক কথায় নাকচ  হয়ে গেল, ডঃ   বিভীষণকে       প্রচুর গালি দেওয়া হল। বিভীষণ বাবু ডীন , উপাচার্য, এদের সবাইকে গিয়ে  কমপ্লেন করলেন, কিন্তু কিছুই লাভ হল না ( বছরে কয়েক লক্ষ ডলারের ওভারহেডের টাকা  আসে অশকের গ্রান্ট  থেকে – পাতি অভিযোগ কেই বা শুনবে?)

বিভীষণের  মাথায় ভাল বুদ্ধি এল। ভাল করে সব ডকুমেন্ট  জোগাড়  করে কানসাসের বড় খবরের কাগজ, কান্সাস টাইম্‌স-এ জমা দিলেন। সেখানে  এক ঝানু সাংবাদিকের এই ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখা গেল। উনি নিজেই আবার বসন্তের সদস্যদের, গবেশকদের, আর অশোকের সহকর্মীদের সাথে সাক্ষাৎকার করলেন।

কিছুদিন পরে কাগজে বোমা পড়ার মত  exposé       বেরোল    দুটো পরপর,

Indian origin American professor stealing students research, sold for a million dollars”

এই খবরে ছিল, গবেষক রমেশের সাথে সাক্ষাৎকার – “প্রোফেসর অশোক আমার দুই বছরের গবেষণার  রিপোর্ট নিয়ে নিয়েছেন। ওই  রিপোর্টে নতুন কানের ওষুধের  ফরমুলা ছিল, উনি আট  কোটি  টাকায় সেটা  একটা  প্রাইভেট কম্পানিকে বেচে দিয়েচেন, ওরা পেটেন্ট নিয়ে নিয়েছে “।

“Indian origin American Professor treats his students as servants, makes them do chores and run errands without pay”

এই খবরে ছিল, বিভিন্ন গবেষকের কথা, যারা অশোকের  হুকুম মত খাবার পরিবেশন করত, বাসন মাজত, ঘাস কাটত , এইসব আর কি।

বলাই বাহুল্য, এ  খবর একেবারে ভাইরাল হয়ে গেল। এবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের টনক নড়ল । উপাচার্য ভান করলেন যেন  এই সব অভিযোগ  তিনি প্রথম শুনলেন। অশোককে সাসপেন্ড  করা হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ স্তরের প্রশাসকদের নিয়ে তদন্ত শুরু হয়ে গেল।

ওমা, আমেরিকার  পুলিশ আর শ্রমদপ্তর তাদের নিজেদের  তদন্ত শুরু করে দিল বেআইনি কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগে। আবার আমেরিকার আয়কর দপ্তর তদন্ত শুরু করে দিল আয়কর ফাঁকির অভিযোগে। ইউএসএ জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের তদন্ত শুরু হয়ে গেল বেআইনি পেটেন্ট নেওয়ার ব্যাপারে। সব থেকে বড় ব্যাপার, ইমিগ্রেশন আর এফ বি আই এসে গেল বিদেশি নাগরিকদের নিয়ে Human Trafficking এর ব্যাপারে তদন্ত করতে!!

কিছুদিনের মধ্যে অশোকের অবস্থা শোচনীয়! চার পাঁচটা মামলার খাঁড়া মাথার ওপরে!!

উকিলের পরামর্শে অশোক মামলার মধ্যেই গেল না।

অশোক চাকরি থেকে ইস্তফা দিল। কোন  দোষ স্বীকার করল না কিন্তু। ফলে সব তদন্তই গুটিয়ে  নেওয়া হল। উকিলের পরামর্শেই  অশোক কয়েক কোটি ডলার গবেষক রমেশবাবু আর উনিভারসিটিকে  দিয়ে দিল প্যাটেন্টের  দাম হিসাবে , ওরাও প্যাটেন্টের মামলা তুলে নিলেন। বাকি ওর রিটায়ারমেনটের টাকা, প্যাটেন্টের  টাকা , সবই অশোকের  কাছে রয়ে গেল।

সব মিলিয়ে অশোকের  আর্থিক  ক্ষতি কিছুই প্রায়  হল না। কিন্তু অসম্মান হল খুব  শেষ  জীবনে।  এই ঘটনা না ঘটলে অশোক  হয়ত আরো দশ বছর  চাকরি করতে পারত, ওর দুই সাম্রাজ্যই বজায় থাকত ।  কোন নতুন গ্রান্ট, কোন  নতুন চাকরি আর পাওয়া সম্ভব নয় ওর  পক্ষে । প্রবাসী  বাঙ্গালিরা এবং প্রবাসী  ভারতীয়রা ওকে  এড়িয়ে  চলে। সহকর্মীরা ওর  সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না।  শেষ  জীবনটা  অশোকের

একা একাই কেটে  যাবে  মনে হয়। ওর  স্ত্রী  তনুশ্রী কিন্তু বরাবরই ওকে খুব ভালবাসে আর যত্ন  করে। ছেলেমেয়েরা সব বড় হয়ে আমেরিকার অন্য শহরে চলে গেছে, এখন ওরা দুজনে সেই বিশাল বাড়িতে একাই  থাকে।

এগুলো কি হেরা দেবীর শাপের ফল? চল্লিশ বছর পরে ফলেছে?  অশোকের বিয়ে  তো দিব্যি টিকে আছে। সুতরাং আমি বলব এটা  ওর দুর্ভাগ্য, নিজের অহংকারের জন্যই ওকে   বুড়ো   বয়েসে ঝামেলায় পড়তে হয়েছে।  হেরা দেবীর  অভিশাপ আজকাল আর কাজ করে না – দিন কাল বদলে গেছে!

গুগুশার গল্প

গুগুষার গপ্পো

আমরা বাঙ্গালিরা  (এবং  ভারতের লোকেরা) দুর্নীতি , চুরি, আর ভণ্ডামি  অনেক দেখেছি। এই তো গত বছরের জুলাই মাসে, পশ্ছিম  বাংলার শিক্ষা মন্ত্রির বান্ধবীর বাড়িতে পঞ্চাশ কোটি  টাকা  ক্যাশ উদ্ধার করা হোল

আর এই মাসে সন্দেশখালির মস্তানকে ধরা হয়েছে যে প্রায় পুরো সহরটাই তার বাপের জমিদারি করে  ফেলেছিল।  আরও  কতো কোটি টাকা চুরির গল্প রোজই বেরোয় টিভিতে তার ঠিক নেই। পুকুরচুরি ছাড়াও

রোজই  আপনার চোখের সামনেই বিভিন্ন সরকারি  প্রোজেক্ট থকে চুরি হয়ে যায় , স্কুল, হসপিটাল, রাস্তা সারান , পার্ক  ও উদ্যান রক্ষা সব কিছুর থেকেই একটা ভাগ দাদাদের কাছে চলে যায়। এছাড়াও চাকরি পেতে ঘুষ,  ধার পেতে ঘুষ, বাড়ি  তৈরি করতে ঘুষ,  কতো আর বলব।

এত রকম দুর্নীতি ভারতে আছে যে আমরা বিদেশের দুর্নীতির ঘটনাকে খুব একটা  পাত্তা দিই  না। কিন্তু

গুগুষার গপ্পো আপনাদের ভাল লাগবে, নতুন অনেক মজার কথা শুনবেন ঃ

গুগুষা (ভাল নাম গুলনারা) পড়াশোনায়  বড়  ভাল ছিলেন । উনি প্রথমে কলেজ থেকে একটা স্নাতক ডিগ্রি পান  “আন্তর্জাতিক অর্থনীতি”  বিষয়ে । তারপরে উনি আমেরিকা চলে যান । সেখানে প্রথমে New York -এর Fashion Institute of Technology থেকে  ডিসাইন-এ একটা ডিগ্রি করেন। তারপরে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে Regional Science -এ একটা  Master’s degree করেন (হাহাহা!)

এরপরে বিদুষী দিদিমণি নিজের দেশে তাশখন্দ ইউনিভার্সিটিতে  ফিরে আসেন। সেখানে political science -এ একটা পি এইচ ডি  করে ফেলেন। ব্যাবসার সুবিধে হবে   বলে আবার একটা স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে নেন Telecommunications -এ।

হাঁপিয়ে  গেছেন নাকি?  বিদুষীর পেশা কি ছিল?  তা উনি হচ্ছেন উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মেয়ে – কারিমভের মেয়ে গুলনারা কারিমভা । এতসব ডিগ্রি পেয়ে উনি তাশখন্দ ইউনিভার্সিটিতে  পলিটিকাল সায়েন্সের অধ্যাপক ছিলেন। তাছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক এজেন্সির আধিকারিক হিসাবে প্রশাসন দপ্তরেও ওনার বিরাট প্রতাপ ছিল।

উজবেকিস্তান ছোট দেশ  ইন্ডিয়ার তুলনায় – ওদের  জনসংখ্যা সাড়ে তিন  কোটি , আর আমাদের ১৩৫ কোটি !!

লোকজন অনেকেই বেশ গরিব, ফ্যাশনেবল দামী জামাকাপড়ের ক্রেতার সংখ্যা  কম। কিন্তু এই ছোট  মার্কেট পুরো  কন্ট্রোল করেন গুগুশা দেবি। সমস্ত ফ্যাশনেবল দামী জামাকাপড়ের  ডিসাইন উনি নিজেই করেন, বাইরে থেকে এগুলো   আমদানি করা  বারণ। আর যেসব দোকানে ওই  কাপড় বিক্রি হয়,  তার মালিকও হচ্ছে  গুগুষার  কম্পানি।! ডাবল মনোপলি যাকে বলে।

উজবেকিস্তান ছোট দেশ  , তাই একটাই মোবাইল ফোন কম্পানি ছিল, সেটার শেয়ারের সিংহভাগ  আবার গুগুশা দেবীর  হাতে!

প্রাইভেট মিডিয়া ,  টিভি , নিউজ পেপার ,তাও গুগুশার নিয়ন্ত্রনে!

উজবেকিস্তানের পুরনো হসপিটালগুলো ফ্রি, কিন্তু ভাল চিকিতসা হয় না, অনেক নতুন   প্রাইভেট  হসপিটাল খোলা হয়েছে স্বাধীনতার পরে। ওমা গুগুশার  কম্পানির সেখানেও গরিষ্ঠ মালিকানা আছে।

(যদি কারো সন্দেহ হয়,  আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি এই সব ডিগ্রি গুলো দুনম্বরি আর ব্যাবসা গুলো  মালিকদের কাছ থেকে  বাজেয়াপ্ত করা বা  লুট  করা !!)

দিদির প্রতিভার শেষ  নেই। অত অধ্যাপনা, গবেষণা, আর প্রসাশনিক কাজের মধ্যেও উনি সময় করে নাচ গান এইসব করেন। ওনার নিজেরি একটা রক ব্যান্ড আছে, সেখানে ওনার  লেখা গান গেয়ে উনিই  পারফরম করেন। এইসব শো ইউরোপের  নামকরা সহরে দামী  হল ভাড়া করে দেখান হয়, অনেকেই শুনতে আসে (হাহাহা)। আসবেই তো ! গুগুশার সোনালি চুল, মিষ্টি হাসি, আর বাংলায় যাকে  বলে  ফাটাফাটি এনডাওমেনট , এইসবের  টান  কি এড়ানো যায় ? যদি ইচ্ছে হয়, ইউ টিউবে দেখবেন দিদিকে, নিজের গানের তালে নিজেই নাচছেন, কি সুন্দর!!

দিদির বাবা কারিমভ  কাকুর  কথা একটু শুনুন এবারে। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ল , মধ্য এশিয়া আর পূর্ব ইউরোপে অনেক নতুন দেশের জন্ম হোল । ইসলাম কারিমভ উজবেকিস্তানের অত্যাচারী  ডিকটেটর  হিসাবে তার একনায়ক তন্ত্র চালিয়ে গেলেন পঁচিশ বছর ধরে। সোভিয়েত স্টাইলের  নিয়মে সব অর্থনৈতিক কাজের ওপরই  নিয়ন্ত্রন ছিল , পারমিট লাগত, ট্যাক্সও দিতে হত। বিদেশ থেকে জুতো আমদানি করলেও ট্যাক্স, আবার এদেশ থেকে কাপড়  রপ্তানি করলেও ট্যাক্স। একটা  নেটওয়ার্কের পকেটে এই ট্যাক্সের ভাগ চলে যেত। এই নেটওয়ার্কে  প্রথমে ছিলেন কারিমভ কাকুর সাঙ্গপাঙ্গরা , পরে আমাদের গুগুশা দিদিই এর নেত্রী  হয়েছিলেন।

দেশের লোকের  প্রতি কারিমভ কাকুর খুব একটা সহানুভুতি ছিল না – ওদের থেকে   কাজ আর টাকা আদায় করলেই উনি খুশি। ওনার ক্ষমতার অপব্যাবহারের একটা বড় উদাহরন দিচ্ছি ঃ উজবেকিস্তানে প্রচুর তুলোর চাষ হয়। যখন তুলোর ফসল কাটার সময় হয়, তখন  একই সঙ্গে অনেক  শ্রমিকের    দরকার হয়ে পড়ে। তাই কাকু ফতোয়া জারি করলেন যে  ওই সময় দুমাস স্কুল কলেজ সব বন্ধ থাকবে।

সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা,     শিক্ষকরা   অধ্যাপকরা, প্রশাসকরা , স্কুল কলেজের অন্য কর্মচারীরা, সবাই (মোট দশ লক্ষের বেশি)  দল বেঁধে গ্রামে চলে যাবে, সারাদিন ধরে তুলোর ফসল তুলবে!  সেই তুলো একটা সরকারি সংস্থা বিদেশে রপ্তানি করে, লাভের সিংহভাগ চলে যায় কারিমভের  জটের  মধ্যে। কি ভাল ব্যাবসা বলুন ত?

কারিমভ কাকু গুগুশাকে নিজের রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সব কিছুই প্লান মত চলছিল। গুগুশা এক আফগান-উজবেক ব্যাবসাদার পরিবারের ছেলেকে বিয়ে করেন, তার নাম মনসুর মাক্সুদি – তিনি আবার আমেরিকার নাগরিক। ওদের পাঁচটা  প্রাসাদ ছিল – লন্ডন, নিউ ইয়রক, লস আঞ্জেলেস, পারিস আর তাশকেন্ত সহরে , বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন স্বামী স্ত্রী এবং ওদের দুই ছেলেমেয়ে। আগের লেখা থকেই বুঝেছেন যে ব্যাবসা ভালই চলছিল।  কেউ কেউ বলে যে গুগুশার নিজের সম্পত্তির মুল্যায়ন প্রায় ৮০০০ কোটি ডলারের মতো হয়েছিল শেষকালে !!

কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে সবই বদলে গেল !! ২০০৫ সাল নাগাদ গুগুশা ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাসখন্দে  চলে আসে, অর স্বামী তখন ছিল আমেরিকায়। দুজনেই বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করে, তারপরে প্রচুর  গণ্ডগোল সুরু হয়। সন্তান্ দের     কাসটোডি  নিয়ে, সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে, আমেরিকার কোর্ট এবং উজবেক কোর্টে প্রচুর মামলা শুরু হয়ে যায় , আস্তে আস্তে পরিবারের অন্যরাও এতে জড়িয়ে  পড়ে। ইন্তারপোলের গ্রেফতারের পরোয়ানা বেরিয়ে যায় গুগুশার নামে, উনি আমেরিকায় এলেই নিজের   ছেলেমেয়েদের কিডন্যাপিঙ্গ এর অপরাধে গ্রেফতার হবেন। আবার অনেক গ্রেফতারের পরোয়ানা বেরিয়ে যায় তাসখন্দে,  মন্সুর জামাই  ও  তার  পরিবারের  লোকেদের নিয়ে , পুলিস তাদের হেনস্থা করতে শুরু করে।

গুগুশার নিজের জীবনধারাও  এই সময় উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল । ওনার প্রেমিকদের  সম্বন্ধ্যে গুজব  প্রায়ই   ছড়াত,  শোনা    যাচ্ছিল যে গুগুশা কারিমভ কাকুর যে  উপদেষ্টাকে বিয়ে করতে চলেছেন বয়েস তার অনেক কম।

কারিমভ কাকু  ডিকটেটর  মানুষ , মেজাজ তুঙ্গে থাকে সবসময়। ২০১৩ সাল নাগাদ তিনি আর এসব সহ্য করতে পারলেন না। ঠিক কি হয়েছিলো বলা শক্ত, কিন্তু কাকু মেয়েকে কিছু  চড়চাপড় দিয়ে গ্রেপ্তার করার আদেশ দিলেন, তারপর থেকেই  গুগুশা তার প্রাসাদোপম বাড়িতে কয়েদি হয়ে রইলেন  – house arrest!!

২০১৬ সালে  কারিমভ হারট অ্যাটাক হয়ে মারা গেলেন। উজবেকদের আশা বাড়ল, এবারে নতুন্   সরকার এসে একটু স্বাধীনতা দেবে নাগরিকদের। ওমা , মুখে মুখে রিফরম আর স্বাধীনতার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত কিছুই হোল না। নতুন রাষ্ট্রপতি , শাভকাত মিরজি হলেন কারিমভ কাকুর ডান হাত, উনি   কারিমভের আমলে  প্রধান মন্ত্রী  ছিলেন , এখন হয়েছেন রাষ্ট্রপতি।

নতুন প্রশাসন গুগুশাকে আরো ঝামেলায় ফেলল। নতুন করে, ঘুষখোর , দুর্নীতি এবং  racketeering  এর অভিযোগ আনল। বিদেশি তিনটি সরকার, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং আমেরিকা গুগুশার বিরুধ্যে নতুন সব অভিযোগ আনল। এই সব মামলার নিস্পত্তি হয়ে গেল শীঘ্রই  উজবেকিস্তানের কাঙ্গারু কোর্টে , গুগুশার ১৫ বছর কারা দণ্ড  হোল নতুন করে!!  ফলে নিজের প্রাসাদোপম বাড়িতে  থাকার বদলে ওনাকে উজবেক জেলে নিয়ে যাওয়া হোল।

সেখানেই এখন আছেন উনি। ওনার মেয়ে বড়  হয়ে গেছে, সে মাঝে মাঝে মার লেখা পিটিশণ ইন্টারনেট -এ পোস্ট করে। সেখানে গুগুশা তার মানবিক অধিকার ধংস করা হয়েছে,  ওনাকে মানসিক অত্যাচার করা হয়েছে, এই সব নিয়ে অভিযোগ করেন।

খুব একটা কেউ এসব  নিয়ে পাত্তা দেয় না! কেনই বা দেবে?

যেদিন ট্রেন স্টেশন পালিয়ে গেলো !!

 যেদিন ট্রেন  স্টেশন  পালিয়ে গেল!

জীবনের প্রথম পচিশ  বছর আমি কলকাতায় কাটিয়েছি  ফলে অনেকবার অনেক রকম ট্রেনে চড়ার অভিঙ্গতা হয়েছে। গণ্ডগোলও হয়েছে  অনেকবার। টিকিট হারিয়ে গেছে, ট্রেন মিস হয়ে গেছে, স্টেশন ছেড়ে  গেছে,  কিন্তু ট্রেন  স্টেশন পালিয়ে  যাওয়ার মতো ঘটনা কোনদিন    ঘটেনি !!

আমেরিকায় গিয়ে দেখি, ট্রেন  খুব একটা জনপ্রিয়  নয়। প্রায় সকলেরই গাড়ি আছে, বিশাল চওড়া  হাইওয়ে আছে সারা দেশ ছড়িয়ে। লোকাল ট্রান্সপোর্ট আমেরিকার ৮০% জায়গাতেই নেই  বললেই চলে, ফলে ট্রেনে করে কোথাও  গেলে সেখানে আবার গাড়ি ভাড়া করতে হয়। পরিবারে তিনজন বা তার বেশী লোক  থাকলে  গাড়ি করে যাওয়ার মাথা পিছু খরচাও কম পড়ে , আর অনেক স্বাধীন  ভাবে  ঘোরা যায় ।

১৯৮০ সাল থেকে প্লেনের  ভাড়া  অনেক কমে গেল deregulation –  এর জন্যে । গাড়ির কারখানার

মালিক পুঁজিপতিরা আর লোভী রাজনৈতিকরা অনেক কায়দা  করে আমেরিকার ট্রেনের বারোটা বাজিয়ে দিলেন। ২০০০ সালের পর থেকে আমেরিকায়  একটাই যাত্রী বাহক  ট্রেন কোম্পানি রইল  , নাম Amtrak, বাকি ট্রেন কোম্পানিগুলো সব লাটে উঠে গেল।

 এই  Amtrak খুব একটা  সুবিধের নয়  –    বেশী জায়গায় চলে না, অনেক সময় লাগে, অনেক লেট হয়, ট্রেনের ভেতর খাবার পাওয়া যায় না ভাল । আমেরিকা খুব বড় দেশ, ফলে নিউ ইয়র্ক থেকে ক্যালিফোর্নিয়া প্লেনে যেতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা  লাগে  আর ট্রেনে লাগে পাঁচ ছয় দিন!

কিন্তু চিরকাল এরকম ছিল না। ১৯০০ থেকে ১৯৫০ আমেরিকায় ট্রেন -এর স্বর্ণযুগ , আজকাল থেকে আকাশ পাতাল তফাত। সমস্ত দেশে প্রচুর ট্রেন চলত ইন্ডিয়ার মতন, বিশাল বিশাল ট্রেন  স্টেশন ছিল সব

বড় শহরে। ট্রেন station গুলো খুব বড়, ছাত অনেক গুলো ২০০ ফুট বা তার বেশি উঁচু , মধ্যে ১৪/১৫ টা প্ল্যাটফর্ম আছে। শীতকালে যখন বাইরে খুব ঠাণ্ডা, ট্রেনগুলো  স্টেশন -এর ভেতরে চলে আসত একদম যাতে যাত্রীদের ঠাণ্ডা না লাগে। ছোট শহরগুলোতেও  ভাল ট্রেন স্টেশন ছিল। প্রায় সব সহরেই বাস, ট্রাম, ট্রলি, ট্যাক্সি পাওয়া  যেত ফলে প্রচুর লোক ট্রেনে করে যাতায়াত করতো।

১৯৫০ সালের পর থেকে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থার খুব উন্নতি হতে শুরু হোল । সাধারন মানুষের   আয় অনেক  বেড়ে গেল , প্রায় সকলেই গাড়ী কিনতে শুরু করলো । পেট্রলের দামও খুবই কম। বিশাল চওড়া  হাইওয়ে  সারা দেশ ছড়িয়ে সরকার  তৈরি করতে শুরু করে দিল। এইসবের মধ্যে ট্রেনে চড়া আস্তে আস্তে অনেক কমে গেল, আগেই   বলেছি  ১৯৮০ সালের পরের থেকে ট্রেন লোকে  প্রায় চড়াই ছেড়ে দিল।

ট্রেনের দিন তো  চলে গেল, কিন্তু মস্ত বড় স্টেশন গুলো তো  রয়ে  গেলো । যেখানে  প্রতিদিন কয়েকশো গাড়ি  চলত, সেখানে এখন ১০ টা  ট্রেন সারাদিনে চলে হয় ত।

 স্টেশন গুলো শুধু  আকারে বড় নয়, অনেক যত্ন   করে  তৈরি করা, অনেক টাকা খরচা  করে।

তা কি হবে ওই সব  স্টেশন গুলোর? অনেক সরকারি সংস্থা , অনেক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক , অনেক বিশ্ববিদ্যালায়ের গবেষকরা নানা রকম plan করে এই স্টেশন গুলো  সংস্কার করে নতুন কাজে ব্যাবহার  করার রাস্তা দেখালেন। প্রায়  কুড়ি তিরিশটা  স্টেশন নতুন করে করা হোল। ভেতরে  ট্রেনের মিউসিয়াম, ঐতিহাসিক মিউসিয়াম , শিশুদের মিউসিয়াম, প্ল্যানেটারিয়াম , আইমাক্স সিনেমা, এইসব করা হল। ট্রেন কোম্পানির

অফিস আর গুদামঘরগুলো  ব্যাবসাদারদের ভাড়া দেওয়া হল।  কোন কোন স্টেশন -এ হোটেল, শপিং মল, ফুড  কোর্ট , এইসব খুলেও লোকজন আকর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

আমি আমেরিকার ক্যানসাস উনিভারসিটিতে  প্রায় ৩৫ বছর পড়িয়েছি। ২০০৫-৬ সাল নাগাদ একটা   মজার পারট -টাইম কাজ করার সুযোগ পেলাম।  আপনারা GRE, GMAT, TOEFL এইসব পরীক্ষার কথা নিশ্চয়ই  শুনেছেন, এগুলো আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়তে ঢোকার আগে নিতে হয়, সারা পৃথিবীর ছাত্ররা এই পরীক্ষা দেয় । ওই রকম একটা পরীক্ষা হয়  হাই স্কুল শেষ করার আগে, তাকে বলে এ পি  এক্সাম (advanced placement examination)। পরীক্ষার সমস্ত খাতা, অনেক হাজার, একসঙ্গে দেখা হয়

আমেরিকার সিনসিনাটি শহরে। আমি  অর্থ শাস্ত্রের খাতা দেখার কাজ পেয়েছিলাম।  আট দিনের কাজ, প্লেন ভাড়া, খাওয়া দাওয়া সব ফ্রি। আবার একটা  নামকরা  পাঁচ তারা হোটেল যার নাম  সিনসিনাটি হিলটন, সেখানে আমাদের থাকতে দেওয়া হোল । আমি বোধ  হয় দশ  বছর টানা ওই  কাজ  করেছি। গরমকালে যখন সিনসিনাটিতে খুব ভাল আবহাওয়া, তখন এক সপ্তাহের কাজ, ভাল হোটেলে  থাকা, ফ্রি খাওয়া, সন্ধেবেলায় কাছের পার্কে গিয়ে গান শোনা , আর সপ্তাহের শেষে  সাত দিনের  পারিশ্রমিক  – ভালই কাজ !!

না, তবে, দিনে   টানা আট   ঘণ্টা খাতা দেখতেও হতো, ঘুম পেত খুব।

২০১০ সালে হবে হয়ত, আমার পুরনো  ছাত্র  দেবুর  সাথে অনেক দিন পরে ফোনে  যোগাযোগ  হোল। দেবু আমার প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিল অনেক দিন আগে, এখন  একা একা  শিকাগো  সহরে থাকে –  ওর জীবনে অনেক দুঃখের ঘটনা ঘটে গেছে, সেসব আর এখানে বলছি না।

ওর সঙ্গে দেখা করার ঝোঁক  চেপে  গেল। শিকাগো    থেকে  সিনসিনাটি বেশি দূরে নয়।  ঠিক করলাম  

শনিবার রাতে সিনসিনাটি থেকে বেরিয়ে শিকাগো চলে যাবো ,  দেবুর সঙ্গে একটা  দিন  কাটিয়ে   সন্ধ্যের  প্লেন ধরে ক্যানসাস সিটি চলে আসব। সোমবার সকালে আমায় ক্লাস পড়াতে হবে, ছুটি হবে না।

এই সব প্ল্যান  গোড়াতেই  ভেস্তে গেল। সিনসিনাটি থেকে  শিকাগো ,  মাত্র এক  ঘণ্টার প্লেনে ওড়ার জন্যে ভাড়া দেখি ৪০,০০০  টাকা  – বাপ রে !! সাধারন সময় ওই  টিকিটের দাম থাকে ৯০০০ টাকার মত,  জানি না কি হয়েছিল। রাত্রে  চলে এইরকম একটা বাসের খোঁজ  পাওয়া গেল, ভাড়া  কম, কিন্তু  ছোট  একটা   ব্যাগ নিয়েই উঠতে হবে, বড় ব্যাগ নেওয়া যাবে না। আমার আবার  সাতদিনের কাজে  রোজ পরার  জন্যে ভাল  জামা কাপড় টাই জ্যাকেট সব  আনতে হয়েছে , দুটো      সুটকেস ভর্তি হয়ে গেছে, সে নিয়ে তো বাসে ওঠা যাবে না!

 হটাত  ভাবলাম ট্রেন  ভাড়া দেখা যাক তো! ট্রেনের ওয়েবসাইটে দেখি  একটা  স্পেসাল  ভাড়া –  মোটে  এক সপ্তাহের জন্য, – ৩০০০ টাকা মাত্র। রাত্রি  দেড়টার সময় ছাড়বে আর সকাল দশটার  সময় শিকাগো পৌছবে। দেবুর সঙ্গে সন্ধ্যে ছটা অবধি সময় কাটান যাবে।  টিকিট কাটা হয়ে গেল অনলাইনে, দেবুকে   ফোন করে দিলাম!

সিনসিনাটি শহরে খাতা দেখার যে সম্মেলন হয়, তাতে আমেরিকার বহু জায়গা থেকে অনেকে   আসেন, অর্থ শাস্ত্র ছাড়াও অন্য বহু  বিষয়ের শিক্ষকরা আসেন। ওখানেই আমার সঙ্গে  মাইকেল  কলিন্সের সঙ্গে আলাপ হল। মাইকেল ক্যানসাসের একটা ছোট   শহরের পুঁচকে কলেজে পড়াতেন,  সাদা চুল আর দাড়ি , মুখে হাসি লেগেই আছে। আমরা রোজ আড্ডা  মারতাম।  যে শনিবার রাতে শিকাগোর ট্রেন ধরবো, সেদিন আমাদের কাজ দুপুরের পরে শেষ  হয়ে গেলো। দুপুরের খাবার খেতে খেতে মাইকেলকে বললাম

“আজ রাতে ট্রেনে করে শিকাগো যাবো” ।

“ সে কি, প্লেন কি হোল? “ উনি খুব অবাক হলেন।

“প্লেনের একগাদা ভাড়া চাইছে। আমি কম দামে একটা ট্রেনের টিকিট কেটেছি। ইউনিঅন  স্টেশন থেকে

ছাড়বে রাত একটায়। আপনি জানেন সেটা  কোথায় ?“ আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“না, কিন্তু ম্যাপ দেখে বার করা যাবে।“ মাইকেল্ বাবুকে একটু  চিন্তিত  মনে হল। ভুরুটা কুঁচকে বললেন

“জানেন আমি অনেকদিন আগে এদেশে ট্রেনে করে ঘুরতে গেছি, আমার অভিজ্ঞতা খুব খারাপ। স্টেশনগুলো শহরের খারাপ জায়গায় হয়,  চতুর্দিকে চোর  বদমাইশ  লোক  ঘুরে বেড়াচ্ছে , স্টেশনের মধ্যে খুব নোংরা , খাবার দাবার পাওয়া  যায় না। অতো  রাতে আপনি কেন যাচ্ছেন? শেষকালে বিপদে পড়বেন নাকি?”

এবার আমি চিন্তায় পড়লাম। খানিকক্ষণ চিন্তা করে মাথায় একটা আইডিয়া এলোঃ

“মাইকেল স্যার, শুনুন কি বলছি। এখন এই দুপুরে আমাদের কিছুই করার নেই, চলুন একটা ট্যাক্সি করে

, স্টেশনটা দেখে আসি।  যদি সুবিধে না হয়, শিকাগো যাওয়া বাতিল করে দোব।“

দুজনে একটা ট্যাক্সিতে ওঠা হল। ট্যাক্সি ড্রাইভার ইউনিঅন স্টেশনের নাম জানে দেখলাম, সোজা  নিয়ে  গেল। অফিস পাড়ার মধ্যে এক   রাজসিক স্টেশন – প্রাসাদের মত চেহারা, দুটো গম্বুজ আছে, কাছে পিঠে কিন্তু লোকের  বসতি  নেই।

স্টেশনের মধ্যে অনেক কিছু আছে। জুন মাসের প্রথমে, স্কুল সব ছুটি হয়ে গেছে, অনেক  ছেলেমেয়ে এসেছে  দল বেঁধে । দুটো মিউসিয়াম আছে, একটা ছোটদের জন্যে, আর একটা প্রাকৃতিক ইতিহাসের (natural history)। আমরা দুজনেই  মিউসিয়াম দেখতে খুব ভালবাসি, প্রাকৃতিক ইতিহাসের মিউসিয়ামটা আগেই ঘুরে এলাম। আমেরিকার ওই জায়গার শহর ও গ্রামের  গত দুশো বছরের ইতিহাস, পুরনো    দিনের চাষিদের জীবনযাত্রা , কারখানার  শ্রমিকের জীবন , তাদের বাড়ি, আসবাব পত্র , ঘোড়ার গাড়ি, – সব কিছু  ছবি, পূর্ণাকার  (life-size) মডেল , ভিডিও,  এইসব  দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজান।

মিউসিয়াম দেখে আমরা ওখানের ফুড  কোর্টে চলে গেলাম। পুরনো   স্টেশনের 
প্রধান প্রবেশকক্ষ, দুশো ফুট উঁচু ছাত, সেখান
ফুড  কোর্ট বানিয়েছে, স্কুলের ছেলেমেয়েরা হুল্লোড় করছে । 

কফি খাওয়া হয়ে গেলে  মাইকেল বাবু বললেন “ সবই  তো  হোল ,   তা  ট্রেন  স্টেশনের দেখা তো  পাওয়া  গেলো  না। কোথা  থেকে ট্রেনে উঠবেন ?”
আমি   বললাম “ সত্যি, এত সব জিনিস  আছে কিন্তু রেলগাড়ির কোন  দেখা নেই। 
নিজেরাই  বাড়িটার  মধ্যে ঘুরে দেখলাম। প্রাসাদের মত  স্টেশন , দোকান ,  মিউসিয়াম , এইসব ছাড়াও প্রায় পঞ্চাশ ষাটটা ঘর  তালা চাবি দিয়ে বন্ধ – আগে  নিশ্চয়ই  নানারকম রেলের অফিস ছিল,

 একটা  কাউনটার  দেখা গেল, লেখা আছে “খবর এবং সহায়তা” (information and assistance)। সেখানে একটি  খুবই  কম্ বয়সী  মেয়ে, খুব  হাসিখুশি, সবার  প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে ।
আমরা তাকে প্রশ্ন করলাম “মিস, এখানে  Amtrak -এর  স্টেশনটা কোথায় জানেন? যেখান থেকে ট্রেন ছাড়ে?”

এই প্রশ্নটা শুনেই ওই সুন্দর মেয়েটার হাসি বন্ধ  হয়ে গেল ভুরু কুঁচকে গেল। গম্ভীর ভাবে আমাকে বলল “ স্যার। এখানে আমি পাঁচ বছর কাজ করছি, কোনদিন  কোন ট্রেন দেখিনি। আমি  তো  শুনে অবাক! 
মেয়েটার পেছনেই  একটা বড়  নোটিস বোর্ড  ছিল, সেখানে  যত  স্থানীয় ব্যাবসাদারদের বিজ্ঞাপন , খাবার দোকানের  বিজ্ঞাপন, খেলাধুলার ইভেন্ট এর বিজ্ঞাপন, আরও কত কি! মাঝখানে কিন্তু একটা ছয়  কোণা  Amtrak -এর লোগো ঝুলছে ! আমি মেয়েটাকে  বললাম  “এইতো  স্টেশনের লোগো আছে, এখানেই কোথাও  স্টেশনটা হবে।“
শুকনো মুখ করে মেয়েটা বলল। “একটু দাঁড়ান স্যার, আমার বস -কে জিজ্ঞাসা করি।“ 
বস এলেন, একজন বয়স্ক মহিলা। 
“ স্যার, আমি এখানে দশ বছর কাজ  করছি, এই মস্ত বাড়ির সব জায়গাই আমার চেনা -   কোনদিন স্টেশন দেখিনি, যাত্রীবাহী  ট্রেন দেখিনি, ট্রেনের কর্মচারী দেখিনি, টিকিটের  জানলা দেখিনি, আর কি বলব আপনাকে ! একটা পুরনো ট্রেন লাইন আছে স্টেশনের পেছনে, সেখান দিয়ে শুধু মালগাড়ি  চলে, সেটা  বড়  পাঁচিল  দিয়ে আলাদা করা, কোন স্টেশন কিন্তু সেখানে  নেই , সেখানে যাবার রাস্তাও নেই।
আমি, আর মাইকেল বাবু এসব শুনে তো ডবল অবাক!
মাইকেল বাবু বললেন “ আমার বন্ধু তো  কনফারম করা  টিকিট কেটেছে , ওখানে লেখা আছে  রাত দেড়টার সময় স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়বে, আর কোন স্টেশন আছে নাকি এই সহরে?” 
ওই দুই মহিলা অনেকবার ক্ষমা চেয়ে নিলেন “ আমরা আর কিছু জানিনা। টিকিটের  ওপরে  একটা  ফোন নাম্বার লেখা থাকবে, সেখানে ফোন করে দেখুন”।
আমরা আর কি করব!! মাথা চুলকাতে চুলকাতে হোটেলে ফিরে এলাম। টিকিটের ওপরে লেখা   ফোন  নম্বরে  ফোন  করে কিছুই হল না।  ফোনে একটা রেকর্ডিং বার বার বলতে লাগল “ ট্রেন রাত দেড়টায়  সিনসিনাটি সহরের   ইউনিয়ন  স্টেশন থেকে ছাড়বে , স্ট্যাটাস ওকে!” একই কথা বার বার বলে, লাইভ মানুষের    গলা আর আসে না কিছুতেই, বিরক্ত হয়ে ফোন ছেড়ে দিলাম।
শেষ পর্যন্ত  মনস্থির করে  মাইকেল বাবুকে বললাম
“আমি ওই  ট্রেন  ধরব স্যার!”
“সত্যি ?   কোথা  থেকে? “ উনি দেখি মুচকি মুচকি হাসছেন।

“ শুনুন” আমি বললাম  “ রাত সাড়ে বারোটার সময় একটা  ট্যাক্সি করে ওই  স্টেশনে যাব। যদি ট্রেন পাওয়া যায় ভাল, না হলে আবার ট্যাক্সি নিয়ে হোটেলে ফিরে আসব। আপনি আমার ঘরের চাবি রেখে দিন, আমি যদি না আসি কালকে চেক আউট ডেস্কে চাবি ফেরত  দিয়ে  দেবেন, ঠিক  আছে তো? হোটেলের ঘরের বিল আগামিকাল দুপুর  বারোটা অবধি দেওয়া আছে। আর যদি ফিরে আসি, আপনার ঘরে গিয়ে আমার চাবি নিয়ে আসব গভীর  রাত্রে।

দুর্গা দুর্গা বলতে বলতে, রাত সাড়ে বারোটার সময় ট্যাক্সি ধরলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভার একজন বয়স্ক  আমেরিকান, উনি খুব সন্দেহ প্রকাশ  করলেন, “আমি ইউনিঅন স্টেশনে  যাত্রী  নিয়ে গেছি দিনেরবেলা হয় শপিং মলে বা মিউসিয়ামে, কিন্তু  ট্রেন ধরার জন্য  কোনদিন  কাউকে নিয়ে যাই নি।  আমার ধারনা ছিল এখান থেকে ট্রেন উঠে গেছে । “

দেখ কাণ্ড!

যাই হোক , ট্যাক্সি অফিস পাড়ায় এসে পড়ল , সব অন্ধকার। ইউনিঅন স্টেশনের অতো বড় বাড়িটায় কোন  আলো জলছে না। একটা পুঁচকে ধারের দরজা খোলা  আছে, একটা ইলেক্ট্রিক বাল্ব জলছে,

একটা সাইন ঝুলছে লেখা ঃ Amtrak!!

ওই  দরজা দিয়ে ঢুকলাম।

বাড়ির  মধ্যে সব আলো নেভান, একটা করিডরে শুধু টিমটিম করে কম পাওয়ার -এর আলো  জ্বলছে , অনেকটা  ভেতরে গিয়ে অনেক বন্ধ অফিসঘর,   শুধু  একটা ঘরের   বাইরে আলো জলছে – লেখা আছে

WELCOME

Cincinnati Union Station

AMTRAK

Hours : 12:00 midnight to 4:00 AM

Sundays, Tuesdays and Fridays only

ছোট  কাঠের   দরজা  ঠেলে  ভেতরে গেলাম। একটা  ওয়েটিং রুম,  প্রায় তিরিশটা কাঠের চেয়ার দেওয়া, আমাকে নিয়ে মোট  ছয় জন যাত্রী অপেক্ষা  করছে। ট্রেনটা নিউ ইয়র্ক থেকে আসছে , দুই ঘণ্টা  লেট –  টিকিট ঘরের গায়ে  নোটিস লাগান আছে। টিকিট এবং লাগেজের জন্যে দুজন , একজন হাউস কিপিং , আর একজন ইঞ্জিনিয়ার / বড়বাবু ।  মোটে চারজন   কর্মচারী  দেখলাম, হয়ত আরও দুএকজন ছিল।

সপ্তাহে তিন দিন দুটো করে ট্রেন যায় , রাত দেড়টার সময় নিউ ইয়র্ক – শিকাগো, আর সাড়ে  তিনটের সময় উলটো দিকে শিকাগো – নিউ ইয়র্ক ।

এইখান থেকে আগে  দিনে কয়েক শো ট্রেন যেত , আর আজ কি  হাল হয়েছে!  দিনের বেলা  মলে বা দোকানে   যারা   কাজ করে, তারা এই চার জন কর্মচারীকে দেখতেই পায়না, Cincinnati Union Station -এর সাইন সরিয়ে নেওয়া হয় যখন স্টেশন বন্ধ থাকে। স্টেশন  পালায় নি, স্টেশন ছোট হয়ে গিয়ে  লুকিয়ে  পড়েছে !! লোকে ধরেই নিয়েছে যে স্টেশন উঠে গেছে !

যাই হোক , দুই ঘণ্টা কাঠের চেয়ারে বসে পিঠে ব্যাথা হয়ে গেলো। খাবার বলতে শুধু জলের বোতল ছিল ওখানে।

ট্রেন এল রাত সাড়ে তিনটের সময় । চেয়ার কারে আমার সিট পড়েছিলো। ভাল সিট গুলো। নরম, হেলে যায় অনেকটা । ঘুম হোল কয়েক ঘণ্টা ।

সকালে আটটায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। ডাইনিং কারে কিছুই পাওয়া গেলনা। শুধু কালো ইনস্ট্যান্ট কফি, দুধ নেই,, কিছু বিস্কিট আর প্লাসটিকে মোড়া শুকনো  কেক। তাই খেয়ে রইলাম দুপুর  একটা  অবধি ।

আমেরিকার পশ্চিম দিকে যেখানে প্রছুর পাহাড় আছে, সেখানে ট্রেন  থেকে খুব সুন্দর সিনারি দেখা যায় ।  আমাদের  ট্রেনটা কিন্তু  সমতল ভুমির  ওপর দিয়ে যায় – শুধু চাষের জমি আর ছোট ছোট  শহর। সিনারি একেবারে নর্মাল,  সুন্দরের কোন  ব্যাপার নেই । আমেরিকার ছোট সহরগুলোতে অনেক  ফ্যাক্টরি ছিল আগে, জুতো , জামা,  বাসনপত্র, আসবাব,  electronincs,   আরো কত কি তৈরি হোতো আমি দেখেছি ৮০ আর ৯০ -আর দশকে।  এখন চাইনিস আমদানি  এবং  globalization -এর  চাপে পড়ে প্রায় সব কারখানাই উঠে গেছে। কারখানার ফাঁকা বাড়ি আর যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে  আছে  অনেক জায়গায়, দেখলে মনটা  খারাপই হয়ে যায়।

একটার সময়  শিকাগো এসে  গেলো , আমার ছাত্র দেবু প্লাটফর্মেই দাঁড়িয়ে ছিল। মনটা  খুব ভাল হয়ে গেল প্রায় কুড়ি  বছর পরে ওর  দেখা   পেয়ে। আমরা কাছেই একটা  গ্রিক রেস্তোরাতে  চলে গেলাম। পেট  খিদেয়   জ্বলে যাচ্ছিলো । পিটা ব্রেড , হাম্মাস, তাহিনি, রোস্ট ভেড়ার মাংস, আর একটা   মহিতো  (মকটেল নয়, আসল মাল!)  খুব করে খেয়ে দেবুর ফ্ল্যাটে  গেলাম। সেখানে ওর সোফায় শুয়ে পুরনো  দিনের কথা বলতে বলতে চোখ ঘুমে  ভরে গেল।

“ রাতে ঘুম হয় নি, দেবু!  ঘণ্টা  দুয়েক  পরে দেকে দিও” – এই বলে সে কি ঘুম!

তিন ঘণ্টা ঘুমের  পরে  দেখা গেল আর গল্প করার সময় নেই!! চলে গেলাম মেট্রো করে  এয়ারপোর্টে , সেখান থেকে  ক্যানসাসে আমার বাড়ি আসলাম রাত এগারটায়! ছুটি খতম!

দেবুর সঙ্গে বুড়ি  ছুঁয়ে দেখা হল এবারে, কিন্তু এর পরের বছর শিকাগোর ভাল হোটেলে ঘর ভাড়া করে কয়েক দিন ছিলাম, দেবুর  সঙ্গে অনেক কথা হোল তখন।

ট্রেনের ব্যাপারটা খুবই মজার হয়েছে,  ট্রেন  স্টেশন পালিয়ে  যাওয়ার কথা  এখনো মনে পড়ে।

তারপর আর আমেরিকায় ট্রেন  চড়া হয় নি একবারও!

 
 
 

A Felon and an SOB

A convicted felon and an SOB

Peter was fat. And tall. He was a white boy who had already done some time in prison. He was the convicted felon.

 Selim was short and skinny, from Bangladesh. He was a professor in a small college in Kansas city.

Dr. Selim was a big SOB – OK OK, I will explain later. 

Peer and Selim, this mismatched duo, visited me together for the first time about twenty years ago, in my house in Kansas, where I worked as a professor in a big college.  Selim I knew already from before, he was coming regularly to my house for Indian food.  I looked at Peter with some well-deserved curiosity –  who the hell is this guy? A colleague ?  A friend?  A neighbor of Selim?

Peter solved this problem by asking me a multiple choice question:

“Look at me carefully”, he said “ Am I

  1. An undercover police officer?
  2. A retired wrestler?
  3.  A Bodyguard to a Kansas City Mafia Boss?
  4. A convicted drug dealer. ?

I went for 3. which was wrong, and we all laughed and he revealed that he has been out  of prison only for the last three years. Somewhat alarmed, I was worried that he would maybe do a line of coke right in my living room. Fortunately, that did not happen. He was kind of shy too, so I did not hear about his life story until later. Both Peter and  Selim the SOB ate a lot of my beef curry that I made with Indian spices.

Over the next few months I will meet Peter and Selim frequently. Selim’s house was about  60 kilometers from mine, so either he would come over to mine or I would go over to his place. Peter would usually tag along. He lived in inner Kansas City with his mother, about 30 kilometers away from Selim’s house.  We were all big foodies.  Mostly, I will cook large amounts of beef, chicken or fish; Selim the SOB will make rice and salad; and Peter would wash the dishes.

Slowly, Peter started talking. He grew up in an old neighborhood in Kansas City.  When he was  born, it was a mixed  neighborhood of both blacks and whites.  Overtime,  as the suburbs of Kansas city expanded, many white people left for the suburbs . His white parents stayed behind, so he grew up with a lot of black neighbors and friends.

He was big and lethargic. He was not very bright, either.  After graduating from high school, he remained either unemployed or worked in fast food restaurants at minimum wage. This went on for a while, then the local drug dealers in his neighborhood noticed him.   

First, the local supplier, a boy that he knew from his neighborhood, gave him  some coke at deeply discounted prices. A few months later, when he started enjoying the subsidized dope,  this boy told him that Cushenberry wanted to see him. Cushenberry was the local drug boss, no one knew his first name! With some trepidation, he went with the boy to his house. It was kind of surreal!

It was a normal looking house, but big, with about a dozen rooms. It had grills on every door and window.  As    you go in the main door, there was  a hallway where two strawberries hung out. In case you do not know, strawberries are severely drug-addicted women whose skin and hair lose pigmentation from long periods of severe malnutrition and drugs. Their hair turns a sickly reddish color, hence the name strawberries. They hang out at the entrance and offer sexual services in exchange for drugs  to all the customers who visit the house.

Inside the house, there were armed sentries at every entrance and an armed man manning a slew of surveillance cameras. There were people whose jobs were similar to  accountants, sales personnel, and  purchasing managers just like in a big corporation. There were several people  in charge of dispensing and counting massive amounts of cash. Several of these employees lived at the premises with their wives/girlfriends.  Most of the residents were black men whereas their women were very beautiful, mostly white and some underage, all  addicted to drugs. There were children of these women of different ages romping around the house among stacks  of cocaine, weed, crack crystals, drug paraphernalia, and many handguns and machine guns. Children played around people sprawled out on the floor, out from various drugs. It was indeed  a modern Dickensian scene .

He met Cushenberry at the inner sanctum of the house, he was shirtless, and muscular, a black man in his early forties. A woman was massaging his shoulders. He basically made small talk with Peter for a few minutes and then let him go. He was just checking him out. Peter was employed for   the next two years by this gang, running small errands and getting paid peanuts. Afterwards , he got a mentor who trained him to be a courier for six months, His life changed after that.

After a few training runs, his life as a courier began in earnest. His car, or rather, Cushenberry’s car, was fitted with a false top and a lot of extra side pockets hidden  around the seats. When he started his sojourn from  Kansas City, the car was stuffed with about a million dollars worth of cash. He went directly south from Kansas city, all the way through Kansas, Oklahoma, and  many many miles through Texas. The journey from Kansas City to Brownsville, a dusty, humid town in the southern tip of Texas was about 1600 kilometers long. That’s where Peter crossed the border. Looking  at him, the agents at the border could only think of a tall fat white kid who  gets no chance to score any  pretty women in USA – his rotund stomach,  reversed baseball cap, sheepish grin , chubby cheeks and the  loud,  tasteless  stereo music  in his car all corroborated this hypothesis. It was clear to the border patrol that he was going to use the services of escorts and party wild in Mexico. They never associated drug smuggling with Peter.  

Peter entered Mexico and checked into a hotel. His Mexican business associates soon met him and took his car away for about an hour, relieving him of all the cash.  He spent the night, usually freaking out, no party, no hookers, taking anti-anxiety pills in his hotel room. The next day , he drove back to USA, absolutely clean, no drugs, no cash in his car  and checked into a designated motel right after crossing the border.  His business associates  came again and delivered the merchandise, usually cocaine , that was stuffed in his car. He drove back to Kansas City, for about 18 to 20 hours without stopping or sleeping,  only  eating snacks while driving ; keeping himself awake with “speed” (methamphetamine). His work was done as soon as he delivered the merchandise in Kansas City to Cushenberry’s associates. He came home to his mama with 40 to 50 thousand dollars (30/40 lakhs)- not bad for about four days work, and in the  early 1990’s more than many American household’s  annual income.  Yes,  the lady escorts came to him at this time, he could get the prettiest and the most expensive ones in Kansas City!

He would make one trip a month, usually. That would make his annual income close to a staggering $500,000, a half-million dollars a year, a dream for a high school dropout in the  early 90’s. ( a college professor with a Ph.D.  in a renowned university  will make about $45000 per year at that time)

Peter spent a lot of this money. He bought  a farm with fourteen acres of land, opened up a car “body shop” where cars were painted and body damages were repaired. Of course, he renovated his ancestral house where his mother lived, and bought another nice house for himself that he decorated with outlandish sound equipment and five big screen televisions! He also bought about seven cars , by the way!

The dream life continued for a number of years.  Peter observed the inner workings of a drug dealer family. He told me about their acceptable rules of  conduct, and  internal punishment strategies which were rather severe. As an economist, I was impressed with the decentralization of operations that provided a huge safety net for a very risky and illegal  business. Plus the codes – the members always spoke in codes! Drugs and cash were never mentioned directly, not even in obliques. When Peter will arrive in Mexico, he will wait in his car for some total stranger  to arrive and say the code word or words. He will then give the car keys to him so that he can unload all the cash. The same procedure when he came back to the US side – he will say the code words to total strangers to receive delivery of the drugs that he will bring back to Kansas City.   He will deliver the drugs to a different location every time  in Kansas City, again by matching the code words with the recipients.

The dream life fell apart one fine morning in a matter of hours. He got a call from one  of the associates, who said “we received the stuff you delivered earlier”. No code there! He started bawling – he  knew the game was up! The police and the DEA were at his door soon afterwards. They caught him with about two million dollars  of cash  – he was getting ready for his monthly trip to Texas!, But no drugs were found  on his premises. The others in the gang were arrested with drugs – they were prosecuted and convicted – their release from prison is  scheduled to be somewhere around 2030!

Since it is difficult to explain why two million dollars of cash were in his house, his lawyer convinced him to plead guilty to “intent to purchase and distribute illegal drugs”. He was sentenced to fifteen years in prison, and got out in about seven years around 2006. I guess he got lucky!

He told me stories about his life in prison which I will share some other time. What I found very interesting was how futile the rehabilitation process was for him.

First, the government took away all his assets, one by one. Once he was convicted and incarcerated, he will receive legal notices from IRS and DEA claiming that some of his assets was supposedly acquired with income from illegal drugs.  So these assets are being confiscated, plus he was served with a past due income tax bill on these amounts. The onus of proof was on him to show that these assets were legally acquired – the government just grabbed these assets  as soon as he was convicted.

One by one, his cars, his new house, his farm, and his body shop were all taken over by the government agencies. When he got out of jail, he was literally penniless. He started living with his mom in his ancestral house.

The rehabilitation process began at that time. The government will give him grants to go to college. He had already finished his high school requirements and took some college courses while he was in prison.  Now he went to Bradford university in Kansas City for his Bachelor’s degree in Business. He finished that in three years and enrolled in the MBA program there as well. That’s where he met  Salem the SOB, who was his teacher. They started hanging out together soon afterwards.

What about getting a job and supporting himself? Umm, that turned out to be a problem. He was now qualified to apply for a  variety of jobs, but as soon as he disclosed that he was a convicted felon on his job application, the employers will reject him. And it was not possible to lie on his application, because a background check will reveal his past conviction, and he will be sent to jail again for lying which is a parole violation!!

He could work in minimum wage jobs in selected establishments that received grants from the government for employing ex-convicts,  but by the time he finished his college degree, he was overqualified for those jobs!

A nice catche-22 situation – I guess he needed a cash infusion to start a business on his own, but the banks would not lend him money, he would only get loans from other crooks. It’s no wonder that a lot of felons eventually go back to prison in USA.

What about Selim? Why was he a mammoth SOB? Well, he was  merely a garden variety SOB from the Indian subcontinent.  I knew him for three years before I met Peter. He lied to me constantly, about his family, about his past employment , about his failed marriage with a woman from Bangladesh and the subsequent  alleged divorce. Most of these lies were habitual, inconsequential and easily detectable. He just enjoyed bragging and telling tall tales.

 A year before I met Peter, I was dating a nice American woman. When I told him about her, he almost  started salivating.  A few weeks later, he came to my house where he met my friend. We went out for a drink. While getting down from the car, he  casually rubbed my friend’s buttocks with his hand – I did not see it, but she told me about it. About  three months later, we all met again at an Indian get-together. Here he went one step further and pinched her butt, hard. After this I made sure that she was never in the same room as him.

The SOB drove an old jalopy even though he made good money. I had a nice car that he wanted to drive – I always said no! One time we went to a party in Kansas City in my car. While coming back , it started raining. It was dark and rainy, my eyes were hurting from the glare of the streetlights in the rain. Seeing this, he offered to drive the car, and like a fool, I  agreed.

He immediately started driving the car really fast and crashed it within about ten minutes. We were not hurt but the car suffered some serious body damage. My insurance paid for part of it, but I was left holding the bill for the remainder of the repairs, towing the car for about 80 kilometers and paying for taxis to go to work for about ten days. The SOB did not give me any of this money! He flatly refused, saying all the repair places are overcharging me!! I guess me calling him an SOB is justified, the only reason he is in this narrative is because he introduced me to Peter.

 A little while later, someone from Bradford University called me and said that disciplinary actions are being taken against  Selim – apparently, he seriously harassed a female student in his class. Fortunately for him, before he could actually get fired, he found a job in Saudi Arabia and left United States presumably for good. I lost touch with him at that time and with Peter as well because Peter always visited me with him.  I   only talked with Peter on the phone a few more times after Selim left.

Peter seemed to be doing well. His mom actually was doing fine. She was always owning a brand new car that Peter got to drive, and giving Peter a nice allowance frequently. With that allowance, and the government grants to pursue his scholastic endeavors, Peter was a happy ex-con with zero income,   but a lifestyle replete with scholastics, electronics,  alcohol and occasional forays into the aforementioned Kansas City escorts! I wondered about his mother’s source of funds and since Peter was unwilling to divulge this information, I  had to figure this one out myself. You see, Peter was not stupid at all. For about  eight years when he was making a lot of money , he made frequent deposits to a super secret savings bank – no,  not  a Swiss bank, but  a bank called Mom Savings and  Loan. He was the only client  in that bank, the operations of that bank were carefully hidden from bad boys like federal agents and the police. Now that he is a free man, he made regular, albeit modest withdrawals from this bank.

In retrospect, I liked Peter.  He still lived with his mother in the same drug-infested neighborhood, and cavorted with the escorts who were mostly drug addicts. So in the long run, there is a big chance that he will falter and self-destruct. He may end up in prison ten years from now, or he may hook up with a nice gf and settle down.  Rehabilitation, you see, has no guarantees whatsoever!

Illish Mach and Chicago cops – Edited

Illish maach and Chicago Cops – বাংলা অনুবাদ  – Edited 3/13/2023

This story is already on my website in English. This is the first time I am posting a Bengali translation of anything I have written. My dear old friend, Uday Roy, has done a fantastic job of translating this. Uday and I know each other for about sixty years, since primary school. Of course, I could not offer him any money for his services, nor did he ask for it. I bought him a small bottle of Old Monk, his favorite beverage. But my indebtedness to him goes far beyond that as you will see from the excellent quality of his translation.

Since I typed this in Bengali myself, I altered and embellished the original translation by Uday a little bit. Typing in Bengali is not so easy, so a lot of typos remain in spite my best efforts. On March 13, 2023, I finally ran the Bangla Spell checker and cleaned up most of the spelling errors, I hope!  

বাঙ্গালিরা মেছো, মাছের জন্যে  জান লড়িয়ে দেবে – একদম ঠিক কথা !

যখন কোন অভিনব নতুন product বাজারে আসে, তখন কিছু ছিটগ্রস্ত লোক একেবারে হামলে পড়ে সেটাকে প্রথমে কেনার জন্যে পাগল হয়ে যায় –   টাকা খরচা হচ্ছে, সময় নষ্ট হোয়ে যাচ্ছে, তারা কিছুকেই পাত্তা দেয় না।

মনে করে দেখুন iphone – এর প্রথম ক্রেতা, ৬৫ ইঞ্চি টেলিভিশন এর  প্রথম খদ্দের, বা X-BOX বা ঐরকম কোন novel video game – এর প্রথম খেলোয়াড় দের কথা। কত হুজুগ, কত লাইন-এ দাঁড়ান, কত উত্তেজিত আলোচনা ইন্টারনেট –এ। আর প্রথম  ক্রেতাদের সে কি লাফালাফি আর বুক চাপড়ান !

এই হুজুগে যারা মাতে, সবাই জানে কিছুদিন পরে একই জিনিশ অনেক কম দামে সব জায়গায় পাওয়া যাবে,  হয় কয়েক মাস পরে নয়  কয়েক   বছর পরে অনেকের কাছেই এসব  থাকবে , শেষ কালে মোটামুটি জলভাত হোয়ে যাবে, তাও হুজুগ ওয়ালাদের শান্তি হয় না।

 জানেন কি প্রথম ছবি তোলা ফোন প্রথমে প্রায় আশি নব্বই হাজার টাকা দিয়ে লোকে কিনেছে! স্মার্ট ফোন না শুধু ক্যামেরা লাগান ফোন!

তা স্যার, বাঙ্গালিদের –ও এরকম হুজুগ ওঠে মাঝে মাঝে! তবে আমি যে পাগলামির কথা জানি সেটা মাছ নিয়ে। ঘটেছিল অনেক দিন আগে, আপনারা তখন ছোট, আমিও তখন ঘোর সংসারী, বয়েসটা কম, টাকও 

পড়েনি একদম।

 অনেক ভূমিকা হল, এবার গল্পটা শুনুন:

ইলিশ মাছ আর Chicago-র পুলিশ ঃ একটা মেছো গল্প

আপনারা বোধহয় জানেন না ১৯৯২ সালে NRI বাঙ্গালিদের জীবনে এক ফাটাফাটি বিপ্লব হয়ে গিয়েছিলো। ১৯৯২ সালের আগে আমরা ছিলাম শুধুমাত্র সংসারী প্রবাসী বাঙালি। চাকরি চলছে, বাড়ি গাড়ির EMI দেওয়া চলছে, ছেলেমেয়েরা মাঝে মাঝে গ্যাঁড়াকল করছে, বউয়ের সঙ্গে খিটিমিটি হয়ে চলছে –

এইসব আর কি! কিন্তু তারপর এলো ১৯৯২ সাল, আর আমাদের প্রবাসী বাঙালীরা একটা খবর পেয়ে একেবারে আহ্লাদে আটখানা ! আমরা এক লাফে হয়ে গেলাম বিশ্বের সব থেকে খুশী NRI এর দল! একেবারে! জবাব নেই!

একটু বুঝিয়ে বলি:

জাপান দেশের লোকেরা প্রচুর মাছ খায়, অনেক কাঁচা মাছও খায় তাকে সুশি বলে। ওদের সব সময় চেষ্টা কি করে মাছ টাটকা রাখা যায় । ওরাই একটা বিশেষ Deep Freezer বার করল সেটা মেছো নৌকো বা জাহাজে তুলে রাখা যায় জ্যান্ত মাছ জাল থেকে তুলেই জ্যান্ত অবস্থায় সেই Freezer এর ভেতর ফেলে দিলে মাছ একদম  টাটকা থাকে বহুদিন ধরে। এই পদ্ধতিকে বলে Fresh Frozen. অন্য যে Frozen মাছ পাওয়া জায়, সেটা সাধারণ বরফে চাপা দেওয়া – মাছ পচে যায় না, কিন্তু স্বাদ থাকে না খুব একটা । Fresh Frozen আর Frozen, দুটোর স্বাদের আকাশ পাতাল তফাত।

আমাদের বাংলাদেশী বন্ধুরা জাপানিদের কাছ থেকে license নিয়ে সেই যন্তর পদ্মা নদীর মেছো  নৌকায় লাগিয়ে দিল। অন্য জায়গায়ও লাগিয়ে দিল। আর পদ্মা নদীর ইলিশ , আর অন্য জায়গার  ভেটকি, পাবদা, কই এইসব লোভনীয় বাংলাদেশের মাছ একেবারে টাটকা অবস্থায় Fresh frozen করে রপ্তানি শুরু করে দিল।

১৯৯২ সালে আমেরিকায় এই মাছ বিক্রি হতে শুরু করে, মোটে কটা মাত্র বড় শহরে  – New York, Los Angeles, Chicago ইত্যাদি

দুঃখের ব্যাপার হল কি, এত বড় খবরটাকে কেউই পাত্তা দিলো না। না ন্যাশনাল প্রেস, না রিজিওনাল প্রেস, না ইন্টারন্যাশনাল প্রেস, কোন কাগজে নয়,  কোন টিভি তে নয়ই  – কি অন্যায় বলুন তো?

India Abroad নামে একটা সাপ্তাহিক তখন বেরত। ফ্রি পত্রিকা , প্রবাসী ভারতীয়দের কাছে  গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে এইরকম খবর সব  বেরত এখানে। কেউ কেউ চোখ বুলিয়ে দেখতেন, বাকিরা ফেলেই দিতেন পাঁচ মিনিট দেখে। ওখানেই ভেতরের পাতায় একটা পুঁচকে আইটেম, ছাপা হল ওই  বিশেষ খবর  মৎস্য বিলাসীদের জন্যে।

কোন কোন বাঙ্গালিদের এটা চোখে পড়ল, তাদের চোখ বড়বড়, কান খাড়া হয়ে গেল যেরকম   বিড়ালের হয় শিকে ছিঁড়ে গেলে !! 

আমরা Chicago থেকে  ৮০০ কিমি. দূরে একটা ছোট শহরে মোটে ৩০/৪০ জন বাঙালি থাকতাম। জায়গাটা সমুদ্র থেকে প্রায় ২০০০ কিমি. দূরে। আমাদের চাকরি ছিল ,  গাড়ি বাড়ি ছিল, সংসার ছিল। মুরগি, ভেড়া,  সবরকমের  সবজি, ইন্ডিয়ান মশলা এসব দিয়ে খাওয়াও ভালই হত। কিন্তু ওই  মাছের ব্যাপারে বেশ গণ্ডগোল  ছিল। আমেরিকান মাছ ত্রাউত, স্যাল্মন , পারচ,  এসব ভালই খেতে যদি টাটকা হয়, আমাদের ওখানে সবই Frozen বিক্রি হতো  – কোন  টেস্ট নেই।

মাঝে মাঝে অনেক বেশি  দাম দিয়ে বড়বড় চিংড়ি আনা হোতো – খেতে ভাল কিন্তু পকেট হালকা হয়ে যেত  । ইলিশ মাছ তো স্বপ্ন, আবার পদ্মার ইলিশ –  ও রে বাবা !

তা এই খবরটা বেরোনোর পরে সারা আমেরিকায় বেধড়ক ফোনাফুনি  শুরু হয়ে গেল –  কথা বার্তার নমুনা শুনুন

“পদ্মার  ইলিশ খাবি”?

“কোথায়”?

”Chicago –তে পাওয়া যায়”

“ইয়ার্কি করিস না”!

“মাইরি বলছি”

“টাটকা?”

“একদম ফ্রেশ”

“কি যে বলিস!”

খবরটার সত্যতা যাচাই করে, শিকাগোর দোকানের নাম ঠিকানা নিয়ে আমদের ছয়জন বাঙ্গালীর মীটিং বসলো।

প্ল্যান তৈরি হয়ে গেল। আমরা , যারা কিনা প্রবর্তক অর্থাৎ পাইওনিয়ার, তারা এই মহামূল্যবান ইলিশের  ধান্দায় শিকাগো শহরে যাব। তারপর এই ক্ষুদ্র শহরের আমাদের ভাই বেরাদরদের মাছের হাহাকার মিটিয়ে দেব একেবারে পদ্মা নদীর টাটকা ইলিশ দিয়ে!

সত্য বাবু, বিশুদ্ধ গণিতের অধ্যাপক , উনিও আমাদের মীটিং –এ ছিলেন। উনি যাকে বলে “Habitual Antagonist” – সব সময়  উলটো গাইবেন।

“ এতো হুজুগে মাতছ কেন ? বয়েস কত তোমাদের ? যাওয়া আসা ১৬০০ কিমি. দুদিন লাগবে ড্রাইভ করতে, এক কাঁড়ি দাম দিয়ে মাছ কিনবে, গাড়ীর তেলই কত খরচা হবে।   তার থেকে এখানেই বড়বড় গলদা চিংড়ি কেনো , বউদের বোলো বিরিয়ানি বানাতে, ভাল করে ভোজ হবে,  অনেক পয়সাও বেঁচে যাবে। দেশে গিয়ে ইলিশ খাবে , এতো হ্যাংলামির কি আছে” ?

সত্য বাবুর সত্য কথা ১-৫ vote- এ হেরে গেল,  বিলকুল !!

 আমরা চারজন একটা  বড় ভ্যান –এ কোরে শনিবার সকালে ৭ টা নাগাদ বেরিয়ে যাব ঠিক করলাম , বিকেল ৬ টা ৭ টার সময় পৌঁছে যাবো।  পালা করে প্রত্যেকে দুই ঘণ্টা চালাবো, একদম ক্লান্তি হবে না। মাছের দোকান ৯ টা অবধি খোলা। মাছ কিনে, একটু  ডিনার  খেয়ে, আবার গাড়ী চালিয়ে রবিবার সকালে একদম বাড়ী । দুটো মস্ত কুলার যাবে , কেমিস্ট্রি বিভাগে যে গবেষণা করত, সে ল্যাব থেকে প্রচুর “  Blue Ice” চুরি করলো (কাউকে বলবেন না)। ও জিনিশ একেবারে হাই টেক , ২/৩ দিন ফাটাফাটি frozen   থাকে, ইলিশ সেই “ Blue Ice” –এ চাপা থাকবে কুলার এর মধ্যে।

পারফেক্ট প্ল্যান ত হোল। এইদিকে ইলিশের দেবতা মুচকি হাসলেন। বেরনোর দেড় ঘণ্টা পরে, গাড়ি একদম খারাপ হয়ে গেলো

হাইওয়ের ওপরে। সে কি ঝামেলা। অনেক পয়সা দিয়ে মেকানিক জোগাড় হল, রাত ৮- টার সময় গাড়ী ফাইনালি ঠিক হোল ।

“প্ল্যান বি লাগাও” সবাই বলল!  Chicago –তে সকাল ৬-৩০ থেকে rush hour traffic শুরু হয়ে যায়, অনেক কারখানা আছে বলে, কারখানার শ্রমিকরা গাড়ী চালিয়ে মর্নিং ডিউটি যায় ।  হিসাব কোরে

দেখলাম, আমরা গাড়ী চালিয়ে সকাল ৮ টা নাগাদ  মাছের দোকানে পৌঁছে যাব । দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব, ৯ –টার সময় দোকান খুললেই ইলিশ কিনে নেওয়া যাবে।

এখানেও একটু গ্যাঁড়াকল হয়ে গেল। প্রায় ৬০০ কিমি রাস্তায় রাতে কোনও ট্রাফিক নেই , Chicago-র মধ্যেও রাস্তা একেবারে  ফাঁকা – আমরা ভোর ৫-টার সময় ডেভন স্ট্রিট-এ এসে গেলাম, ওখানেই মাছের দোকান। তখন সব অন্ধকার, দুএকটা রেস্টুরেন্ট খোলা আছে প্রাতরাশের জন্যে, আর পুরো  পাড়া একেবারে নিঝুম।  এরিয়াটা খুব  একটা সুবিধের মনে হল না।

বিনয় বাবু বললেন “ আমরা তিনটে রেস্টুরেন্ট-এ যাব, সব জায়গায় এক ঘণ্টা করে বসব, একটু করে খাবো তিন বার, তাহলেই হবে, সময়টা কেটে যাবে”

সবাই আপত্তি করলো – না না  মিছিমিছি অনেক পয়সা নষ্ট হয়ে যাবে। গাড়ী সারাতে কত পয়সা খরচা হয়েছে অলরেডি ভেবে দেখ। 

যে গাড়ী চালাচ্ছিল সে একটা বড় দোকানের পারকিং এরিয়ার মধ্যে গাড়ী ঢুকিয়ে দিল। দোকানটা  বন্ধ তখন। 

“এখান থেকে মাছের দোকান খুব কাছে। আমরা এখানে গাড়ীর কাঁচ তুলে দিয়ে দিব্যি ঘুমিয়ে যাব , দু, আড়াই ঘণ্টা – বাস তা হলেই ত হবে – প্রবলেম সমাধান হয়ে গেল”

আমরা ওর কথা শুনে সীট হেলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ  করে দিলাম – ঘুমও পেয়েছিল খুব!

এ কাজটা আমরা মোটে ভালো করিনি!

একটা ক্লিক শব্দে চমকে উঠে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলেই দেখলাম একটা বন্দুক আমার নাক বরাবর তাক করা। ঠিক যেমন সিনেমাতে দেখায়, কিন্তু বন্দুকটা সত্যি , আর টিভিও দেখছি না। একটা কর্কশ গলায় একজন বলছে শুনতে পেলাম

 “ মাথার ওপর  হাত তুলে খুব আস্তে আস্তে ভ্যান  থেকে বেরিয়ে আসুন “

ছটা শিকাগোর পুলিশ আর একটা বিটকেলে এলস্যেশিয়ান কুকুর ! ছটা  পুলিশের ছটা বন্দুক-ই আমাদের মাথার দিকে তাক করা। কি  বলব স্যার এত ভয় জীবনে কোনদিন পাই নি!

ভ্যান –এর বাইরে পা রাখা মাত্রই, আমাদের আলাদা করে দিল, প্রত্যেককে সে কি জেরা শুরু করে দিল। অবশ্যই আমাদের ব্যাবহার –এর সংগে ড্রাগ ডিলারদের ব্যাবহার-এর কোন তফাত নেই। তারাও শিকাগোর ওই জায়গায় ড্রাগ ডেলিভারি দেয়, ফাঁকা পারকিং লট-এ  গাড়ি রেখে আলো নিবিয়ে খদ্দের –এর জন্যে অপেক্ষা করে – ঠিক আমরা যা করেছি। কি সর্বনাশ বলুন ত?

সকলকেই পুলিস বেধড়ক জেরা করতে লাগলো, কিন্তু আমার  জন্যে স্যার স্পেশাল ব্যবস্থা – কি ভাগ্য আমার!! আমাকে একটা পুলিশ অফিসার ধরে একটা পুলিশের গাড়িতে বসাল। পেছনের সিটে সেই এলস্যেশিয়ান কুত্তী (গালাগাল দিলাম না, কুত্তী কে কুত্তী বলবো না ত কি বলবো?) –   একটু একটু গরগর আওয়াজ মারছে, সৌভাগ্যবশত তাকে রাখা হয়েছিলো পেছনের সিটে , একটা শক্ত ইস্পাতের জালের আড়ালে। প্রায় বিশ মিনিট ধরে আমার জেরা চলল । আমার সব নাড়ী নক্ষত্রের খবর খুব বিনয়ের সঙ্গে

অফিসার বাবু জিগ্যেস করতে থাকলেন । প্রতি পাঁচ মিনিট  অন্তর উনি গাড়ী থেকে বেরিয়ে অন্য অফিসার বাবুদের সঙ্গে শলা করতে  যাচ্ছিলেন। আর যেই না উনি গাড়ী থেকে বেরলেন, কুত্তীটা জালের ওপর ঝাঁপিয়ে পোড়ে, আমার গায়ে লালা ছিটিয়ে সে কি প্রচণ্ড গর্জন । আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ওর দুটো ঝকঝকে শ্বদন্ত, হিংস্র মুখ আমার শরীরের একফুট দূরে, সকালে দাঁত মাজে নি, মুখে কি গন্ধ কি আর বলবো !

অফিসার বাবু গাড়িতে ফিরে এসে, খুব শান্ত গলায় বললেন, “ Susan, একদম চুপ কর” আর জানোয়ারটাও লক্ষ্মী মেয়ের মত গুটিসুটি মেরে  ঘুমাবার ভাণ করতে লাগলো। এইরকম চলল বারবার। পুলিশ মশাই জেরা করে গাড়ী থেকে  বেরিয়ে যান, আর শুরু হয় Susan এর মানুষ মারা চিৎকার।আবার পুলিশ ফিরে আসে, সুসান গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে ।   মনে হয় বার চারেক হোল এরকম । আমি সেদিন বেধড়ক বেঁচে গিয়েছি, ওই মজবুত ইস্পাতের জালের জন্যে, নইলে আর দেখতে হতো না।

আমার অবস্থা একেবারে শোচনীয়, শরীরের  কত কি যে শুকিয়ে গেল তা আর কি বলবো! সুসান নামটা ওর একেবারে মানায়  নি। বাংলায় চামুণ্ডা বা ইংরেজিতে লুসিফার হলে একদম ঠিক হতো ,

পুলিশরা আমাদের অতীত বর্তমান নিয়ে কতরকম প্রশ্ন করল, ভ্যানটা আগাপাস্তলা তল্লাশ করল। দেখল শরীরে অস্ত্র আছে কিনা বা পকেটে ড্রাগ আছে কিনা কারুর। আমাদের আইডি ওদের কম্পিউটার –এ ফেলে, হেড অফিসে ফোন করে , কত কি যে করলো । ওইরকম জায়গায় ভোর  পাঁচটার সময় আমরা মাছ কিনতে এসেছি অত দূর থেকে আর আলো নিবিয়ে চুপচাপ বসে  আছি  ফাঁকা জায়গায় – এটা মোটামুটি অবিশ্বাস্য বললেই চলে। তাই পুলিশকে স্যার আমি একটুও দোষ দিই না। ইন্ডিয়া হলে বোধ হয় আগেই  হাতকড়ি লাগিয়ে থানায় নিয়ে যেতো, দু একটা চড়চাপড়ও দিতো হয়তো।

শেষকালে বিরক্ত হয়ে আমাদের বেকসুর ছেড়ে দিল। একজন বয়স্ক অফিসার একটু ব্যাঙ্গ কোরে আমাদের বললেন

“স্যার, এটা আপনারা খুব বুদ্ধিমানের কাজ করেন নি। এখানে আসল ড্রাগ ডিলাররা আসে, তারা আপনাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে গুলি করে ঝাঁজরা করে দিতে পারত।  অনেক ড্রাগ নেশাখোর পাগলের মত হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়, তারা আপনাদের পেলে গাড়ি টাকা সব  ছিনিয়ে নিয়ে একদম রাস্তায় বসিয়ে দিত। আপনাদের ভাগ্য ভাল পুলিশের নজরে পড়েছেন তাই এসব আর হল না। প্লিস, পরে যখন মাছ কিনতে আসবেন, দোকানগুলো যখন সাধারণ সময় খোলা থাকে  তখন আসবেন মনে করে।“

“সে আর বলতে স্যার, সে আর বলতে !” আমরা কোরাস গেয়ে দিলাম। 

তখনো মাছের দোকান খুলতে দু ঘণ্টা বাকি। একটা ব্রেকফাস্টের ঠেকে গিয়ে কফির অর্ডার দেওয়া হোল – সকলেরই তখন মনের বিধ্বস্ত অবস্থা আর শরীরও ভয়ে মোটামুটি কাঁপছে ভালই। ভাগ্যকে ধন্যবাদ আমাদের কারুরই আন্ডার প্যান্ট পালটাবার দরকার হয় নি, যদিও সুসানের সাথে মোলাকাতের পরে আমার  প্রায় তাই অবস্থা –  কোনরকমে রক্ষা হয়েছে আর কি!!

আর কি, প্রচুর মাছ অনেক পয়সা দিয়ে কেনা হল। আসার সময় আমি প্রথমেই দু ঘণ্টা গাড়ি চালালাম, তারপর সবথেকে পেছনের সিটে শুয়ে ইলিশ ভরা কুলার  জড়িয়ে ধরে ভোঁস ভোঁস করে সে কি ঘুম!

না না  আমরা একদম সেলফিশ নই মশাই, শহরের সব বাঙ্গালিকেই ইলিশ ভোজে নেমন্তন্ন করা হল। সেখানে, ইলিশের ঝাল , ঝোল , অম্বল, পাতুরি, ইলিশ কষা, ইলিশ ভাপা , ইলিশের ডিম ভাজা , ইলিশের তেল – একেবারে হই হই ব্যাপার। আমরা  তো পেট ঠেশে খেলাম। সেই সত্য বাবু, বিশুদ্ধ গণিতের অধ্যাপক তিনিও  এলেন, দেখলাম অনেক গুলো মাছ শেষ করে দিয়েছেন, মুখে হাঁসি  খুব।

সত্য বাবু, গণিতের অধ্যাপকের কথা একেবারে মিলে গেল কিন্তু। মোটে দুই বছরের মধ্যে আমেরিকার প্রচুর যায়গায় ওই মাছ চলে এলো – এখন আমাদের বাড়ি থেকে ৫০  কিমি গেলে যে বড় শহর আছে সেখানে এই ইলিশ সবসময় পাওয়া যায় , যদিও দাম দারুণ বেশি! কিন্তু আমরা গর্বিত আমাদের অ্যাডভেঞ্চার – এর জন্যে। আমরাই প্রথম সহরে ইলিশ আনি – আমরা প্রবর্তক , পাইওনিয়ার একেবারে!  আর এই গল্পটা স্যার, priceless, এতদিন পরেও লোককে বলে খুব মজা করা যায়।

আর কি লিখব? সেই সুসান কে আমি কিন্তু ভুলতে পারিনি । অনেকদিন পরেও সুসান-এর দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে যায়। বউকে বলি  “শুনছ, ভীষণ ভয়ের স্বপ্ন দেখেছি,  ঘামে জামা ভিজে গেছে, একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, আর একটু জল দাও”

“যত ঢং” বউ বলে, “ কবে কুকুর ঘেউঘেউ কুরেছিল, এখনো তার ভয় কাটেনি!” বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।

যা দিনকাল পড়েছে, কি আর বলব?

টরনটোর আশু পুরোহিত

টরনটোর আশু পুরোহিত

 

 ক্যানাডার টরনটো শহরের এয়ারপোর্ট থেকে যদি হাইওয়ে দিয়ে শহরের দিকে যান, তাহলে মাঝখানে অনেক মাইল ধরে বেশী জনবসতি নেই, শুধু বড় বড় গুদোমঘর, কারখানা, পাইকারি আড়ত , গ্যারাজ, এইসবের মধ্যে কতকগুলো  পুরনো দিনের পাথরের বাড়ি আছে, সেইগুলো সংস্কার করে কিছু অফিস বা বাড়ি বানান হয়েছে।

ওইখানেই একটু ভেতরের রাস্তায় দেখবেন একটা পাথরের বাড়ি, খুব সুন্দর করে সারানো হয়েছে, একটা বড় গেটের  পাশে বসে আছেন সাদা চুল আর দাড়ি নিয়ে পাঞ্জাবী এক দাদু । দাদুর কাজ হচ্ছে বোতাম  টিপে  গেট খুলে দেওয়া। একটা বড় সাইন বোর্ডে লেখা Choutala’s Truck Garage and Truck Parts Shop.

বাড়ির পেছনেই একটা ট্রাকের গ্যারাজ আর তারই  সঙ্গে একটা Junkyard, সেখানে ভেঙ্গে যাওয়া লরির নানারকম যন্ত্রপাতি থাকে।জাঙ্কইয়ার্ডএর ব্যাবসা ভালই, অনেকে পুরনো ট্রাকের রেডিয়েটর, কারবুরেটর, এমনকি ইঞ্জিন পর্যন্ত কিনে নিয়ে নিজেদের ট্রাকে লাগায়। ওই জিনিসগুলো অবহেলায় মাটিতে পড়ে  থাকলে কি হবে, ওদের  দাম অনেক।

ওই পাথরের বাড়িতে থাকেন মিস্টার প্রকাশ চৌতালা – হরিয়ানার লোক, কুস্তীগিরের মতো চেহারা, আর ওর স্ত্রী মধু (যার  কথায় পরে আসছি), ওদের কিশোরী মেয়ে আর দাড়িওলা বুড়ো – প্রকাশের বাবা।

ওই বাড়ির পাশে একটা পুরনো খামার বাড়িকে সারিয়ে করা হয়েছে বাল্মীকি মন্দির, চৌতালা সাহেবের ট্যাক্স বাঁচানোর জন্যেই হবে হয়ত। ভেতরে বাল্মীকির মূর্তি, রামায়ণ লিখছেন, রাম লক্ষণ সীতা, এরাও আছেন, দেওয়ালে রামায়ণের বিভিন্ন রকমের ছবি আঁকা।

মন্দিরের পুরোহিত আশু ব্যানার্জি, একদম পশ্চিম বাংলার টাকি শহরের কাছে, ইছামতী নদীর ধারে একটা ছোট গ্রাম থেকে এসেছে। কি করে এলো সেটা অনেক জটিল গল্প, এখানে আর বলছি না। আশুর বাবা অনেক ছোটবেলায় মারা গেছেন, কিছু জমি আছে তার থেকেই ওর মায়ের আর ওর  মোটামুটি চলে যেত। আশু নিজে নিজেই পড়াশোনা শিখেছে ভালই। কলকাতায় থাকলে আশু  হয়ত ভাষাবিদ হতো, টাকির মতো  জায়গাতেও ও ইংরিজি বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত খুব মন দিয়ে শিখেছে, টাকি কলেজ  থেকে সংস্কৃত অনার্স নিয়ে বি এ পাস করেছে। পুরোহিতের কাজ নিয়েছে সুযোগ পেয়ে, আসলে কিন্তু আশু খুব একটা ধার্মিক নয়।বিয়ে করার ইচ্ছে আছে খুব! কিছু টাকা জমলে দেশে ফিরে গিয়ে সংসার করার প্ল্যান!

মন্দির আর চৌতালার বাড়ির পিছনেই হচ্ছে বিরাট জমি নিয়ে জাঙ্ক ইয়ার্ড, লরির পার্টস ছড়িয়ে  আছে, আবার গোটা  দশেক লরির ওখানে রাত্রের গ্যারাজও আছে।   রাত্রিতে পুরো  জায়গায় তালাচাবি লাগান হয়, চারটে বড় রটওয়েলার কুকুর ভেতরে ছেড়ে  দেওয়া হয়, কেউ ঢুকলেই শেষ করে দেবে। জাঙ্কইয়ার্ডএর ঠিক  মাঝখানে একটা ছোট্ট কটেজ, সেখানে থাকে গাঁজাখোর ক্যানাডিয়ান বিলি।

বিলির মাথাটা পুরো নরমাল   নয়, আবার একটু খোঁড়া , বয়েস তিরিশের বেশি, ও কুকুরগুলোকে খাওয়ায় রোজ। কুকুরগুলো ওর  কথাই শোনে শুধু। ওরা দিনেরবেলা বিলির ঘরের পাশে বেড়ার মধ্যে আটকে থাকে, বেশি চ্যাঁচামেচি করে না। আর বিলি গ্যারাজটার একটু  দেখাশোনা করে দিনের বেলায়, খদ্দেরদের সাহায্য করে, ড্রাইভারদের  সঙ্গে গল্প করে,  বাকি সময় গাঁজায় দম মেরে বুঁদ হয়ে থাকে।

মন্দিরের পেছনেই একটা ছোট ঘরে আশু থাকে । তখন  ও যা মাইনে পেত  তাতে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ কিছুই কিনতে পারেনি। ঘরে শুধু একটা  বিছানা, একটা ছোট্ট টেলিভিসন আর একটা টেবিলে অনেক বই – সপ্তাহে একদিন চৌতালা সাহেব ওকে গাড়ি করে লাইব্রেরি নিয়ে যান, আশু অনেক বই ধার নেয়, আর লাইব্রেরির ইন্টারনেট থেকে নানারকম খবর পড়ে।

 যদিও আশুর মাইনে কম কিন্তু মন্দিরের কাজও  বেশি নয়। আশু সকালবেলা মন্দির পরিষ্কার করে খুলে দেয়, ছোট করে একটা পুজোর পরে দুপুরের প্রসাদ ও নিজেই বানায় ফল আর মিষ্টি দিয়ে।টরনটো বিশাল শহর, দুটো  মস্ত  বড়   মন্দির আছে, ছোট মন্দির আছে অনেকগুলো। ফলে আশুর পুঁচকে  মন্দিরে দিনেরবেলা খুব একটা কেউ আসেনা।  

সন্ধ্যেবেলায় বড় করে পুজো, আরতি এইসব করে আশু। সপ্তাহে তিনদিন রামায়ণ পাঠ হয়, তার মধ্যে একদিন মূল সংস্কৃত বাল্মীকি রামায়ণ থেকে আশু পড়ে, বেশ কিছু লোক শুনতে  আসে।

সপ্তাহে চার দিন একজন ভারতীয় রাঁধুনি এসে ভোগ রান্না করে দিয়ে যায় , অল্পসংখ্যক লোকই আসে, চৌতালার পরিবার ছাড়া। পুরী, সবজি, মিঠাই সব থাকে – খেতে ভালই।

এই সুন্দর পুণ্যের জীবনে কিন্তু মাঝে মাঝে বিঘ্ন ঘটায় বিলি। গাঁজা, মদ, সিগারেট সবই বিলি আশুকে অফার করে। মাঝে মাঝে বিলি ওর বাড়ির বাইরে গ্রিলে আগুন জালিয়ে বিফ, শুওর  কত কিছু বারবিকিউ করে। এই সব লোভ আশুকে সামলাতে হয়।

কিন্তু মধু? চৌতালার বৌ মধু, বাড়ির  পেছনে বেরোয় হামেশাই, গরমকালে শর্টস  আর হাত কাটা জামা পরে, অন্য সময় টাইট  জিনস আর গেঞ্জি পরে। ফুলগাছে জল দেয়, বাগানের  যত্ন করে, বা মাঝে মাঝে বাড়ির পেছনের চাতালে বসে আরাম করে। বিলি আর আশু হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। মধু চৌতালার বয়স ৩২/৩৩ হবে, মুখ চোখ একেবারে কারিনা কাপুরের মতো, আর শরীরের গঠন  ্কারিনা

কাপুরের থেকেও ভাল। ওকে দেখে দেখে গাঁজাখোর ক্যানাডিয়ান বিলি আর টাকির পুরোহিত আশু দুজনেই কুপোকাত। যখন সেজেগুজে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে  যায়, আশু জানলা থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে, আর একটা ধবধবে সাদা কামিজ পরে যখন মন্দিরে ভোগ  খেতে আসে, তখন আশু আর চোখ ফেরাতে পারে না। মাঝে মাঝে মধু আশুর সঙ্গে একটু  গল্প করে, আশু তখন তোতলাতে শুরু করে দেয় !!মধু তা শুনে মিটিমিটি হাঁসে।

বিলি মধুকে দেখে আর বলে “ What  a fabulous MILF,  man”!! আশু ইন্টারনেট থেকে MILF কথাটা শিখে  নিয়েছে, ও বিলির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত!

এইভাবেই বেশ চলছিল, আশুর প্ল্যান ছিল পাঁচ বছর কাজ করে, টাকাপয়সা   নিয়ে টাকিতে ফিরে যাওয়া। একদিন রাতে সব এলোমেলো হয়ে গেল।

তখন রাত প্রায় নটা,  হটাত আশু শোনে চৌতালা  সাহেবের গলা। ও নিজেই নিজের লরি চালিয়ে গ্যারাজে ঢুকছে, আর বিলিকে ডাকছে খুব জোরে। বিলি ছুটে  গিয়ে আগে কুকুরগুলোকে আটকে দিলো, তারপর পাটাতন আর মই লাগিয়ে দিল লরির পেছনে। আশু দেখে অবাক ! গারাজের মধ্যে তো শুধু  গাড়ি পার্ক করা হয়, মালপত্র (কার্গো) এখানে আসার কথা নয় তো।

লরির পেছনের দরজা খুলে গেল, আর প্রায় ষাট জন ভারতীয় চেহারার মানুষ  নেমে এল। সবাই সোজা আশুর মন্দিরের চাতালে এসে বসে পড়লো। প্রত্যেকের পরনেই নোংরা জামা আর চান না করার জন্য ভীষণ  গন্ধ – আশুর প্রায় বমি উঠে আ্সে আর কি!

হাসিহাসি মুখে চৌতালা সাহেব এলেন, আশুকে বললেন “ এই লোকগুলো  এখানে দুদিন থাকবে, তারপরই চলে যাবে, তোমার চিন্তার কোন  কারণ নেই”।

আশু বলল “এটা স্যার বাল্মীকির মন্দির , পবিত্র জায়গা, এখানে এইসব কেন করছেন”?

চৌতালা সাহেব উত্তর দিলেন “গুলি মারো পবিত্র জায়গার, ওরা এখানেই থাকবে, চান করবে মন্দিরের জলে, জামাকাপড় পরিষ্কার করবে।তুমি যদি সাহায্য কর, তোমাকে খুশী  করে দেবো , নইলে, তোমার  চাকরি হয়ত চলে যাবে, শরীরের ক্ষতি হবারও সম্ভাবনা আছে”!!

আশু খুব নিরীহ লোক। কিন্তু এইসব শুনে ওর  মাথা গরম হয়ে গেল।

“এটা বাল্মীকি মুনির মন্দির, আর আমি এর পুরোহিত, এখানে আমার কথাই চলবে। আপনারা এখান থেকে বেরিয়ে যান”। এই বলে মন্দিরের ভেতরের দরজা বন্ধ করে ওর  ঘরে চলে গেল রাগে কাঁপতে কাঁপতে।

প্রায় আধ ঘণ্টা পরে, আশুর মাথাটা ঠাণ্ডা হল একটু, ভাবতে শুরু করলো কি করা যায় এখন।

সেই সময়ই ওর দরজায় টোকা পড়লো। ভয় ভয় দরজা খুলে দেখে ওমা এতো মধু এসে গেছে ! প্রচুর পারফুম লাগিয়েছে, আর সেই সেক্সি সাদা জামাটা পরে আছে। ওপরের দুটো বোতাম  আবার খোলা।

ওর হাত ধরে মিষ্টি হেসে মধু বললো “এইসব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছ কেন? চল আমি আর তুমি নায়াগ্রা ফলস চলে যাই। আমার  গাড়িতে করে যাবে, একটা হানিমুন সুইট ভাড়া নেব। দুদিন ওখানে  থাকবে আমার সাথে। যখন ফিরে আসব, সব ঝামেলা মিটে  যাবে।

 “আর মিস্টার চৌতালা”? আশু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।

খিল খিল করে হেসে মধু বলল “আরে প্রকাশই তো আমাকে বলল তোমাকে  নিয়ে যেতে । ফিরে আসার পরে ও তোমাকে একটা  বিরাট বোনাস  দেবে। যাও রেডি হয়ে নাও চট   করে” ।

“ঠিক আছে , পাঁচ মিনিট” বলে আশু ভেতরে চলে গেল । খুব তাড়াতাড়ি আশু ভেবে নিল – একটা বিরাট গণ্ডগোল হতে চলেছে। কারিনা কাপুর ওকে গাড়ি করে নিয়ে যাবে আর দুদিন ওর সঙ্গে থাকবে, আবার ওর স্বামী আশুকে অনেক টাকা দেবে ফিরে এলে!! এইসব হয় নাকি?

আশু ঠিক করল, পালিয়ে যাবে এখনি। মধু যেই সরে গেছে, আশু ছুটে বাইরে পালিয়ে গেল। সোজা ছুট  দিল পাশের বাড়ির  দিকে। পাশের বাড়ি হচ্ছে একটা গুদোম ঘর, প্রায় ২০০ মিটার দূরে!

সেখানের ক্যানাডিয়ান  সিকিউরিটি গার্ড বন্দুক নিয়ে ওর জন্যে রেডি  হয়ে ছিল।

“কি চাই কি , হারামি”? সিকিউরিটি গার্ড আশুকে প্রশ্ন করল। লোকটা খুব একটা ভদ্র বলে মনে হল না।  

আশু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল “ চৌতালার বাড়িতে  অনেক অবৈধ নাগরিক (illegal alien) এসে  গেছে। প্লিস পুলিসে খবর দিন স্যার”।

কি ভাগ্য গার্ড মশাই তক্ষুনি পুলিশ  ডেকে  দিলেন। তারপরে সব সিনেমার মত হয়ে গেলঃ

প্রথমে দুটো, তারপরে দশ বারোটা পুলিশের গাড়ি এসে গেল, বিশাল সার্চ লাইট জালিয়ে সমস্ত অবৈধ নাগরিকদের এবং বিলি, প্রকাশ চৌতালা আর মধুকে হাতকড়া দিয়ে নিয়ে গেল। বাড়িতে  পড়ে রইলো বুড়ো   দাদু  আর মধুর   ছোট   মেয়েটা। আশু গুটি গুটি   ওর  মন্দিরে ফিরে গেল, পুলিশকে জানাল যে ওই পালিয়ে গিয়ে ফোন করেছিলো। পুলিশ বলল “আপনার জবানবন্দি নিতে হবে, কাল সকালে অবশ্য যোগাযোগ করবেন”।

সব রাতেরই শেষ আছে। পরের দিন ঝকঝকে রোদ্দুর,  আর তার মধ্যেই সাদা দাড়িওলা ঠাকুরদাদার সে কি গালাগালি! পাঞ্জাবী ভাষাটা আশু বোঝে  না ভাল, কিন্তু বুঝল, আশুর বাবা মা এবং গাধা শূয়র ঘোড়া এইসবের নিকট সম্পর্ক  নিয়েই   ঠাকুরদাদা বকবক করছেন।শেষ কালে বললেন “নিকাল যাও আভি, শুয়ার  কা বাচ্ছা”!

এই মিষ্টি কথা শুনে আশু তাড়াতাড়ি একটা বড় ব্যাগে  জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে একটা  ট্যাক্সি ডেকে সোজা ওর  ব্যাঙ্কে চলে গেল। যা টাকা  জমেছিল  সব ক্যাশ  করে নেবার পরেই পুলিশকে ফোন করল, একজন অফিসার ওর সঙ্গে দেখা করতে এলেন ব্যাঙ্কের বাইরে রাস্তার ওপরে। গাড়ী থেকে নেবে ওকে ডেকে বললেন

“হ্যালো, আমি টরনটোর পুলিশ অফিসার, বাংলা বলতে পারি একটু একটু , আপনার কেস আমিই দেখাশোনা  করব”।

 বুকের ওপর আইডিতে লেখা রয়েছে আবদুল, ইংরিজি একদম  ক্যানাডিয়ানদের   মতো  বলে, বাংলা বোঝে ভালো  কিন্তু  বাংলা বলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা, তাও বাংলাদেশের বাংলা , আবার আমেরিকার একসেন্ট দিয়ে, শুনতে খুব মজা লাগে।

“চলুন, ওই সামনের  দোকানে গিয়ে একটু ব্রেকফাস্ট খাওয়া যাক” । খাওয়া হলে আবদুল  বলল, “আপনার প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দী আমাদের লাগবে। আমি এক এক করে প্রশ্ন করব, আপনি পারলে ইংরিজিতে নয় বাংলাতে জবাব দেবেন। আমি বাংলা উত্তরগুলো অনুবাদ করে নোবো , আপনার সই  দিয়ে দেবেন শেষে।

জবানবন্দী নেওয়া শেষ  হয়ে  গেলে আব্দুল সাহেব বললেন “ আপনাকে কোর্টে সাক্ষী দিতে হবে মনে হচ্ছে। একমাস এখন কোথাও  যাবেন না”।

এই শুনে আশু খুব কাঁচুমাচু হয়ে বলল “কিন্তু আমার পুরোহিতের চাকরি তো   আজ সকালে চলে  গেছে, এক্ মাস নিজের পয়সায় এখানে থাকলে  জমানো  টাকা অনেক খরচা হয়ে যাবে”।

আব্দুল সাহেব একটু চিন্তা করে বললেন

“ ঠিক আছে, আমি অফিসে ফিরে গিয়ে দেখছি কি করা যায়, দু ঘণ্টা এখানে অপেক্ষা করুন”।

টরনটোর পুলিশের জবাব নেই। এক মাসের জন্যে আশুকে হোটেলে রেখে দিল, খাবার জন্যে পয়সা দিল আবার। যে কানেডিয়ান অফিসার আশুকে হোটেলে নিয়ে  গেলেন, তার কাছ থেকেই আশু সব জানতে পারলোঃ

“ এটা হচ্ছে human trafficking, এই  লোকগুলোকে ইন্ডিয়া থেকে পাচার করে আনা হয়েছে। এদেশে অনেক ইন্ডিয়ানদের কারখানা, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকান এসব আছে।এই লোকগুলোকে এইসব জায়গায় খুব কম টাকায় পরিচারকের বা মজুরের কাজ করান হবে। মিস্টার চৌতালা হচ্ছে স্থানীয় distributor, কিন্তু পেছনে অনেক রাঘব বোয়াল আছে যারা এই বিরাট আন্তর্জাতিক ব্যাবসা চালায়, বহু কোটি  ডলারের  ব্যাপার। আমরা  মিস্টার চৌতালাকে ভয় দেখিয়ে এই পালের গোদাদের ধরার  চেষ্টা করব। আপনি এখানে এক  মাস থাকুন। এটা অফিস পাড়া ,  দিনের বেলা বেরোবেন, রাস্তায় প্রচুর লোক কোন  ভয় নেই, দুপুরের খাবার খাবেন আর রাতের খাবারটা দুপুরবেলাতেই কিনে আনবেন। সন্ধ্যাবেলা হোটেল থেকে বেরবেন না মোটে ।এই দলের গুণ্ডারা কিন্তু আপনাকে খুঁজছে পেলে একদম  লাশ ফেলে দেবে।    গুড লাক”।

হোটেলে বসে বসে আশু শুধু ভাবে কি হতে পারতো । তিনদিন নায়াগ্রা ফলসে পরীর সঙ্গে সহবাস, আর ফিরে এসে প্রকাশের কাছ থেকে মুখ বন্ধ করার টাকা  নিয়ে বড়লোকের মতো আরামে দেশে ফেরা যেত । জীবনে একবার খারাপ কাজ করলে  আর কি হয়েছে!! যাকগে কি আর হবে? বাল্মীকি মুনির সম্মান তো  রক্ষা  হয়েছে।

আশুর ভাগ্যটা ভালো, এক সপ্তাহের মধ্যেই সব ঝামেলা মিটে গেল। বিলীকে একটু  কড়কাতেই সে সব বলে দিলো, ভয় পেয়ে প্রকাশ বাবুও রাজসাক্ষী হয়ে গেলেন। কারিনা কাপুর, ইয়ে মানে মধুকে ছেড়ে  দেওয়া হোল। এবারে আন্তর্জাতিক স্তরে উঠে  গেল কেসটা, রাঘব  বোয়ালের খোঁজে বিভিন্ন  দেশের পুলিশ, এফ বী আই, ইন্টারপোল সব একজোটে কাজে নেবে গেলো।

আব্দুল সাহেবকে অনেক ধন্যবাদ  দেবার জন্যে যাওয়ার আগে আশু একবার ফোন করল। খুবই খুশি মনে হল। আমেরিকান উচ্চারনে বাঙ্গাল ভাষায় প্রশ্ন করলেন

“খতধিন দ্যাসে zআন নাই? সখলে ভাল্ল আসে তো”?                  

হাসি চেপে আশু বলল “প্রায় আড়াই বছর  হয়ে গেলো। চললাম স্যার। অনেক অনেক ধন্যবাদ”।  

একেবারে  আশু এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে উঠে গেলো। ওমা, খাবারের সঙ্গে একটা ছোট বোতল ওয়াইন দিয়ে গেলো, ফ্রী!  সেই খেয়ে  কি ঘুম! স্বপ্নে এলেন বাল্মীকি  মুনি, আমেরিকান কায়দায় ভি সাইন দিলেন, তারপরে একটু  আশীর্বাদ  করলেন, পেছন থেকে রাম, লক্ষণ, সীতা, হনুমান আর জাম্বুবান একটু ভাঙ্গরা নাচ করে তাদের আনন্দ প্রকাশ করল, মধু একবার হাসিমুখে এসে ওদের  দেখেই ভয় পালিয়ে গেলো ! খুশি মনে ঘুম থেকে উঠে আশুর মাথাটা পরিষ্কার  হয়ে গেলো।

“অনেক হয়েছে , এবার ভবিষ্যতের প্ল্যান করতে হবে। যা টাকা জমেছে আড়াই বছরে, তাতে ইছামতী নদীর  ধারে একটা ছোট দোকান খোলা  যাবে, জমি আর দোকান থেকে মোটামুটি চলে যাবে। অবসর সময় সংস্কৃত চর্চা করা যাবে। হ্যাঁ বিয়ে একটা করতে হবে বইকি। কুমারসম্ভব, গীতগোবিন্দ , এইসব থেকে চমৎকার অংশগুলোর অনুবাদ করে বউকে পড়াতে হবে। আর রামায়ণ পড়তে হবে বাল্মীকির স্মরণে।

 জয় বাল্মীকি  মুনির  জয়!