হেরা দেবীর অভিশাপ

This is a work of fiction. Any resemblance between this story or its characters and events or characters in real life is purely coincidental and unintentional.

হেরা দেবীর অভিশাপ

 গ্রীস দেশের পৌরাণিক ইতিহাসে অনেক দেবতার গল্প আছে। যিউস হচ্ছেন দেবতাদের রাজা আর হেরা ওর রাণী। কিন্তু রাজা যিউসের একটু চরিত্রের দোষ ছিল অনেকদিন ধরেই, কম বয়েসি দেবী আর হুরীদের সঙ্গে অনেক রকম ব্যাপার চলত । হেরা যখন মধ্যবয়েসে পৌঁছলেন, তখন তার এইসব আর সহ্য হত না।   অভিশাপ দিতে শুরু করলেন  যিউসের প্রেমিকাদের । এরপরে হেরার নাম হয়ে গেল  ঈর্ষার দেবী।

ঈর্ষার খপ্পরে আমরা সবাই পড়েছি, বেশি আর কম। কিন্তু আমার সহকর্মী নিলাদ্রি ঈর্ষার বশে হেরা দেবীর মত আভিশাপ দিয়েছিল একজনকে ।

কার    ওপর  হিংসা হয়েছিল খুলে বলছি। লোকটার নাম  অশোক, ,  সেই শাপ ফলতে লেগেছিল প্রায় চল্লিশ বছর!

আমি যখন ক্যানসাস উনিভারসটিতে পড়াতে শুরু করি, সে অনেকদিন আগের কথা, তখন অশোক ওখানে ফলিত রসায়ন  বিভাগে (Applied Chemistry) পি এইচ ডি  করছিল। আমরা থাকতাম  একটা ছোট শহরে , আমেরিকার মাঝখানে, যেখানে ভারতীয় খুব কম ছিল, আর বাঙালি তো হাতে গোনা কয়েকজন মোটে।  আমার আবার ওই কম বয়েসে একটু অহংকার ছিল, অশোককে খুব একটা পছন্দ ছিল না। আর গনিতের অধ্যাপক   নিলাদ্রি বাবুর নাক আরো উঁচু ছিল, উনি অশোককে একেবারে পছন্দ করতেন না।

কিন্তু বেচারি অশোকের  কি দোষ? আমি কোনদিন  নিলাদ্রিকে অশোকের  দোষের ফর্দ  দিতে বলিনি, তবে উনি  বিভিন্ন সময় যা সব মন্তব্য করতেন তা নিয়েই একটা বড় লিস্টি হয়ে যেত ঃ

“আরে ফলিত রসায়ন   আবার একটা সাবজেক্ট নাকি? শুধু  অশোকের মতো  কেলানে লোকেরাই  ওইসব পড়তে  আসে !”

“অশোকবাবুর ভুঁড়িটা দেখেছেন ? বাচ্ছা হবে নাকি?”

“জুলফির সাইজটা দেখেছেন? ষাটের  দশকের পরে আর কেউ ওরকম জুলফি রাখে নাকি?”

“অশোক কি কিপটে  রে বাবা! এক পয়সা খরচা করতে চায় না!”

“অশোক কি পরনিন্দে করে  লোকের  পেছনে! ছি ছি!!”

“আমরা মশাই আগেকার দিনের  প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েছি, অশোকের সঙ্গে একটা তফাৎ

তো  আছেই, একটু কথা বললেই সেটা  প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাই না? কোন পড়াশোনা নেই ,কালচার নেই যা তা একেবারে!”

এইসব সুন্দর  সব মন্তব্যের ওপর আমি আর কথা বলতে চাই না, শুধু  কিপটেমির কথাটা একেবারে ঠিক!

অশোক আমাকে একবার  নেমত্তন্ন করে  শুধু মুরগির ডানা  আর  গলার  ঝোল খাইয়েছিল,  ওগুলো আমেরিকায় কেউ খায় না,  জলের দামে বিক্রি হয়!

কিন্তু ঈর্ষা ? অশোক  তখন  ছাত্র, আয়ও খুবই কম, সুতরাং কেউ ওর প্রতি  ঈর্ষা করেনি।

অশোকের থিসিস যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তখন ও ছুটি নিয়ে একবার ইন্ডিয়া গেল দুমাসের  জন্যে। জনগণের মধ্যে খুব গুজব রটতে শুরু হোল যে  অশোকের বাড়ি  থেকে ওর বিয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে ।

গুজবটা ঠিকই  রটেছিল , অশোক  ক্যানসাসে ফিরে  এলো  তনুশ্রীকে    নিয়ে।

তনুশ্রীকে দেখে  সব দেশী  ছেলেদের চোখ  গোল হয়ে গেল!! কি সুন্দর  মুখ আর হাসি!! আর চেহারাটা  মশাই বাংলায় যাকে বলে ভলাপচুয়াস!  আর ব্যাবহার  একেবারে চার্মিং , সবসময় হাসি খুশি।

আমরা পুরুষ মানুষেরা মোটামুটি  সবাই  তনুশ্রীকে দেখেই  কুপোকাত !  আমাদের বৌদের আবার হিংসে  যেমন হল, তেমন      আবার  মজাও হোল, অশোকের  মত কেলানে ছেলের সঙ্গে  তনুশ্রীর  বিয়ে হয়েছে দেখে।

সত্যি কথা বলতে কি, সম্বন্ধ করা বিয়েতে অনেক সময়  ভীষণ  অমিল হয়, এটা  তারই   একটা  চরম কেস বলতে হবে আর কি!!

আমাদের নিলাদ্রি বাবু  কিন্তু ,  এক বিদুষী পদার্থ বিজ্ঞানী মহিলা, কেরালার মেয়ে, তার সংগে অনেকদিন  মিশে বাবা মার অমতে তাকে বিয়ে করেছিলেন।  ওনার কিন্তু অশোক আর তনুশ্রীর বিয়ে একেবারেই পছন্দ হয়ে নি।

“দেখবেন, এই বিয়ে  টিকবেনা !  ওই    সুন্দর মেয়ে কি করে এই মোটা  রাক্ষসের সঙ্গে থাকবে? এ একেবারে বাঁদরের  গলায় মুক্তোর  মালা ! আমি বলছি, অশোকের  বিবাহিত  জীবনে বেধড়ক   বিপর্যয় হতে বাধ্য।“

  • এইসব বলে  উনি ভবিষ্যৎ বাণী   করলেন ,  আরও     কিসব বলেছিলেন রাগ করে, আমার মনে নেই!!

যাকগে, শাপ তো দেওয়া হোল,  কিন্তু  অশোক বহাল তবিয়তে  পি এইচ ডি  শেষ করে দিলো,  আবার গবেষকের চাকরি পেল অনেক দূরের শহরে,  আমরা ওদের  ফেয়ারওয়েল  পার্টি দিলাম মজা করে, যদিও নিলাদ্রিবাবু আসতে পারেন নি অনেক কাজ ছিল!!

অনেকদিন তারপর কেটে গেছে। প্রায় পনেরো  বছর। অশোকের সঙ্গে হটাত ক্যানসাস সিটির একটা দোকানে দেখা । অশোকের  চেহারা আরও ফুলেছে,  আর তনুশ্রীর চেহারা লাবণ্যে ঝলমল করছে।

খুব ভালই আছে ওরা, তাই মনে হোল।  অশোক  পনের বছর অন্য জায়গায় চাকরি করে তারপর ক্যানসাসের একটা ছোট কলেজে বিরাট  চাকরি নিয়ে এসেছে।

ওদের  সংগে নতুন করে যোগাযোগ হল। অশোক খুব ভাল করেছে, অনেক গবেষণায় সফল হয়েছে, অনেক টাকার  গ্রান্ট পেয়েছে  শুনলাম।

  আমাদের এরিয়ায় গ্রান্ট খুবই কম টাকার হয়, একমাস পড়ানোর টাকা, বা কিছু বই কেনার টাকা , বা কনফারেন্সে যাবার টাকা – এইসব আর কি। অশোকের গ্রান্ট শুনলাম     বারো  লক্ষ  ডলার!! অতো টাকা কিসের জন্য? খোঁজ নিয়ে জানলাম  গ্রান্ট  সম্বন্ধে অনেক কিছু।

এই বারো  লক্ষ  ডলার একটা  সরকারী সংস্থা  অশোকের বিশ্ববিদ্যালয়ে দিয়েছে , অশোকের কানের অসুখের ওষুধ বার করার গবেষণা  করার জন্য । এই টাকা দিয়ে ও নিজের  গাড়ি বাড়ি  কিনতে পারবেনা, কিন্তু অন্য প্রচুর সুবিধে পাবে । ওর  বিশ্ববিদ্যালয় এই টাকার  একটা  বড়  অংশ নিয়ে নেবে  overhead

এর জন্য। তাহলেও  বাকি টাকা থেকে ও নিজের পছন্দ মতো  অনেকজন  গবেষক নিয়োগ  করতে পারবে ওর ল্যাবের জন্যে। ল্যাবের যন্ত্রপাতি কিনতে পারবে, ওর অফিসের  জন্য যা  দরকার কিনতে পারবে। তাছাড়াও ওই কানের ইনফেকসনের সংক্রান্ত যত  কনফারেন্স হবে, সব জায়গায় অশোক নিজের সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে যেতে  পারবে। এছাড়াও দরকার মত বই, গবেষণামূলক পত্রিকা, কমপিউটার, এমন  কি  অফিসের আসবাবপত্র   সবই ওই  গ্রান্ট  থেকে এসে যাবে । সব থেকে interesting হচ্ছে যে  ওই  গ্রান্টের টাকা থেকেই ওর উনিভারসিটিকে ওর  নিজের বেতনের অর্ধেক ফেরত দিয়ে দিতে পারে, তা হলে ওকে অর্ধেক ক্লাস পড়াতে  হবে না, সেই সময়টা গবেষণার দিকে লাগাতে পারবে। ওর  নিজের বেতনও কমবে না!!

এইসব বড় গ্রান্ট  পেলে অনেক পণ্ডিতেরই মাথাটা একটু গুলিয়ে   যায়, অশোকের বেলায় ও তার ব্যাতিক্রম  হল না।   নামকরা উনিভারসিটিতে অনেকজন বড় গ্রান্ট পাওয়া অধ্যাপক থাকেন , ফলে কেউ খুব একটা লাঠি  ঘোরাতে পারে না । কিন্তু অশোক একটা    ছোট  উনিভারসিটিতে  ডিপার্টমেন্টের চেয়ারমান হয়ে ঢুকল অত বড় গ্রানট নিয়ে। ওর বস, যে না কি  ওখানকার ডীন , সে  ওর কথায় ওঠে বসে (প্রতি বছর ওভারহেডের টাকা ডীনের কাছে চলে যায়,  ডীন উপাচার্যকে দেখায় এতো  টাকা গবেষণার  জন্য আনা হয়েছে!) অন্য অধ্যাপক্ রা যাদের কারও ওরকম বড়  গ্রান্ট নেই, সবাই অশোকের কাছে কেঁচো হয়ে থাকে। ডিপার্টমেন্টের অন্যতম অংশ হচ্ছে স্নাতকোত্তর গবেষকরা , যারা ল্যাবে সারাদিন কাজ করে। প্রায় জনা পনের  গবেষকের মধ্যে বারো জনই অশোকের গ্রান্টের টাকায় আনা, অধিকাংশই তার মধ্যে ইন্ডিয়া থেকে, অশোক দেশে গিয়ে খুঁজে খুঁজে এদের নিয়ে আসত। এরা অশোকের টাকা থেকে মাইনে পাবে, অশোকের প্রোজেক্ট  নিয়ে গবেষণা করবে, আর কাজ শেষ হয়ে গেলে  অশোকের সুপারিশে অন্য জায়গায় কাজ পাবে,এইরকম ব্যাবস্থা ছিল।  বলাই বাহুল্য যে ওরা অশোককে দেবতার মত ভক্তি করতো।

অশোকের ডিপার্টমেন্টের সাম্রাজ্যের কথা তো  শুনলেন , বাড়িতেও ওর  প্রতাপ ছিল খুব। শহরে বেশ কিছু বাঙালি ছিল, ওদের ক্লাবের নাম ছিল বসন্ত। অশোকের চেষ্টায় বসন্তের মিটিং -এর জায়গা ওর প্রাসাদোপম বাড়িতেই  হবে ঠিক হল। প্রতি শনি/রবিবারে জনা পনের লোক ওর বাড়িতে জমায়েত  হতো।  হয় ক্রিকেট , নয় ভারতীয় গানের ভিডিও, বা  ভারতীয় সিনেমা বা ডকুমেন্টারি অশোকের  বাড়ির

বেসমেনটের বিশাল  ঘরে দেখান হত। 

অশোকের  বউ  তনুশ্রী  প্রায়  প্রতি সপ্তাহেই ১৫/১৬ জন লোকের  জন্য নিজের হাতে রান্না করত, হয় বিরিয়ানি, চিকেন টিক্কা , নয় বাঙালি শুক্ত,  মাছের কালিয়া, এই সব।

মাঝে মাঝে বড়  মিটিং  ডাকা হত, প্ল্যান করার জন্য। প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ জন লোক ছেলেমেয়ে নিয়ে

জড় হত ওই  বিশাল ঘরে। বাড়ির পেছনে এক একরের বিরাট লন, সেখানে বাচ্ছারা খেলতে যেত, আর বড়রা ভবিষ্যতের অনুষ্ঠান গুলো অরগানাইস করত – দুর্গা পুজো,  সরস্বতী  পুজো ,   দিওয়ালী, দোল ,

নববর্ষ, পিকনিক, স্পোর্টস,  সংগীত সম্মেলন, আরও কত কি!  হল ভাড়া, চাঁদা তোলা, কলকাতা থেকে শিল্পিদের নিয়ে আসা , অনুষ্ঠান পরিচালকদের ম্যানেজ করা,  এইসব প্লান অশোক এবং   ওর সাঙ্গোপাঙ্গরা যত্ন নিয়ে তৈরি করতো , বসন্তের সবাই সেগুলো  অ্যাপ্রুভ করত   আলোচনা  করে।

তনুশ্রীর জবাব নেই, এক হাতে পঞ্চাশ জন লোকের  লুচি আলুর দম , বা ফিশ ফ্রাই  বানিয়ে দিত, সঙ্গে  মিষ্টি  আর চা!!

সাংস্কৃতিক সম্মেলনে শিল্পি যোগাড় করায় অশোকের দক্ষতা ছিল সত্যিই  অনস্বীকার্য , অনেকদিন আগে একবছর দিওয়ালিতে  সন্ধ্যা মুখারজিকে  নিয়ে এল, আমরা দুই ঘণ্টা ধরে  ওনার গান শুনলাম। আর একবার শ্রেয়া ঘোষালকে নিয়ে এল, যদিও  ওনার বয়েস অনেক কম ছিল  তখন, কিন্তু গলা সাংঘাতিক।

বাড়িতে “বসন্তের” সাম্রাজ্য, অফিসে গ্রানটের সাম্রাজ্য  । প্রায় দশ বছর ধরে   অশোকের আমেরিকায় আসা ১০০%  সার্থক হয়েছিল –তার পর এদিক ওদিকে ছোট ছোট  গণ্ডগোল  হতে শুরু করে। আমরা কোনদিন ভাবি নি  ব্যাপারটা  এতদূর  গড়াবে।

দশ বছরে অশোকের অহংকার বেড়েছিল খুব, ওর  অনুষ্ঠানের কিছু  একটা ব্যাপার নিয়ে কেউ কমপ্লেন করলেই  ও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠত। অফিসে অন্য অধ্যাপকদের তাচ্ছিল্য করত, অনেকে খুব অপমানিত হতেন।

কিন্তু মুল গণ্ডগোল  হোল ওর গবেষক  ছাত্রদের নিয়ে।  ওরা বরাবরি   আসত অশোকের “বসন্ত” মিটিংগুলোতে , যদিও  অধিকাংশই বাঙালি নয়। অশোকের স্বেচ্ছাচারিতা  যখন বেড়ে গেলো , তখন এদের ওপর হুকুম করা শুরু হোল। প্রতি মিটিং -এর সময় এদের খাবার পরিবেশন করা আর ডিস ধোয়ার কাজ দেওয়া হোল।  বাড়ির পেছনের বড় লনের ঘাস ওদের কাটতে  বলা হোল।   এমন কি  এক বছর খুব বৃষ্টি হয়ে, ওর মিটিং -এর বড় ঘরটা জলে ভরতি হয়ে গিয়েছিল, গবেষকরা  বালতি আর মগ নিয়ে সব  নোংরা জল বার করে দিয়েছিল।

ওই গবেষকরা বাচ্চা ছেলে নয়, এরা post-doc , প্রায় সকলের‍ি পি এইচ ডি আছে। এরা সবাই অসম্মানিত হলেও অশোকের  ভয়ে  মুখ বন্ধ করে রইল। এমন কি,   তনুশ্রীর  লোভনীয় বিরিয়ানি আর চিকেন টিক্কাও দক্ষিণ  ভারতীয় গবেশকদের মোটেই পছন্দ হল না,  কারন   ওরা সবাই তো নিরামিশ খেত শুধু!

এইভাবেই চলত, কিন্তু ২০০৫ সাল নাগাদ ডঃ বিভীষণ গুপ্ত অশোকের ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিলেন, বাঙালি হিসেবে বসন্তেও যোগ দিলেন। তারপরই সব বদলে গেল।

প্রথম পাঁচ বছর উনি চুপচাপ, তারপরে চাকরি পাকা হয়ে গেল আর উনি  অশোকের  বিরুদ্ধে মুখ খুললেন। ডিপার্টমেন্টের সভায় অশোকের নামে দুটো অভিযোগ পেশ করা হোল ঃ প্রথমত, অশোক গবেষকদের গবেষণার  রেসালট  প্রাইভেট   কম্পানির কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে অনেক কোটি টাকা  দিয়ে।

দ্বিতীয়ত, অশোক গবেষকদের ওর  ব্যাক্তিগত কাজে ওর বাড়িতে  নিয়ে যাচ্ছে ।

অশোকই ডিপার্টমেন্টের কর্তা , ফলে এই  অভিযোগ সব এক কথায় নাকচ  হয়ে গেল, ডঃ   বিভীষণকে       প্রচুর গালি দেওয়া হল। বিভীষণ বাবু ডীন , উপাচার্য, এদের সবাইকে গিয়ে  কমপ্লেন করলেন, কিন্তু কিছুই লাভ হল না ( বছরে কয়েক লক্ষ ডলারের ওভারহেডের টাকা  আসে অশকের গ্রান্ট  থেকে – পাতি অভিযোগ কেই বা শুনবে?)

বিভীষণের  মাথায় ভাল বুদ্ধি এল। ভাল করে সব ডকুমেন্ট  জোগাড়  করে কানসাসের বড় খবরের কাগজ, কান্সাস টাইম্‌স-এ জমা দিলেন। সেখানে  এক ঝানু সাংবাদিকের এই ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখা গেল। উনি নিজেই আবার বসন্তের সদস্যদের, গবেশকদের, আর অশোকের সহকর্মীদের সাথে সাক্ষাৎকার করলেন।

কিছুদিন পরে কাগজে বোমা পড়ার মত  exposé       বেরোল    দুটো পরপর,

Indian origin American professor stealing students research, sold for a million dollars”

এই খবরে ছিল, গবেষক রমেশের সাথে সাক্ষাৎকার – “প্রোফেসর অশোক আমার দুই বছরের গবেষণার  রিপোর্ট নিয়ে নিয়েছেন। ওই  রিপোর্টে নতুন কানের ওষুধের  ফরমুলা ছিল, উনি আট  কোটি  টাকায় সেটা  একটা  প্রাইভেট কম্পানিকে বেচে দিয়েচেন, ওরা পেটেন্ট নিয়ে নিয়েছে “।

“Indian origin American Professor treats his students as servants, makes them do chores and run errands without pay”

এই খবরে ছিল, বিভিন্ন গবেষকের কথা, যারা অশোকের  হুকুম মত খাবার পরিবেশন করত, বাসন মাজত, ঘাস কাটত , এইসব আর কি।

বলাই বাহুল্য, এ  খবর একেবারে ভাইরাল হয়ে গেল। এবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের টনক নড়ল । উপাচার্য ভান করলেন যেন  এই সব অভিযোগ  তিনি প্রথম শুনলেন। অশোককে সাসপেন্ড  করা হল, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ স্তরের প্রশাসকদের নিয়ে তদন্ত শুরু হয়ে গেল।

ওমা, আমেরিকার  পুলিশ আর শ্রমদপ্তর তাদের নিজেদের  তদন্ত শুরু করে দিল বেআইনি কর্মচারী নিয়োগের অভিযোগে। আবার আমেরিকার আয়কর দপ্তর তদন্ত শুরু করে দিল আয়কর ফাঁকির অভিযোগে। ইউএসএ জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের তদন্ত শুরু হয়ে গেল বেআইনি পেটেন্ট নেওয়ার ব্যাপারে। সব থেকে বড় ব্যাপার, ইমিগ্রেশন আর এফ বি আই এসে গেল বিদেশি নাগরিকদের নিয়ে Human Trafficking এর ব্যাপারে তদন্ত করতে!!

কিছুদিনের মধ্যে অশোকের অবস্থা শোচনীয়! চার পাঁচটা মামলার খাঁড়া মাথার ওপরে!!

উকিলের পরামর্শে অশোক মামলার মধ্যেই গেল না।

অশোক চাকরি থেকে ইস্তফা দিল। কোন  দোষ স্বীকার করল না কিন্তু। ফলে সব তদন্তই গুটিয়ে  নেওয়া হল। উকিলের পরামর্শেই  অশোক কয়েক কোটি ডলার গবেষক রমেশবাবু আর উনিভারসিটিকে  দিয়ে দিল প্যাটেন্টের  দাম হিসাবে , ওরাও প্যাটেন্টের মামলা তুলে নিলেন। বাকি ওর রিটায়ারমেনটের টাকা, প্যাটেন্টের  টাকা , সবই অশোকের  কাছে রয়ে গেল।

সব মিলিয়ে অশোকের  আর্থিক  ক্ষতি কিছুই প্রায়  হল না। কিন্তু অসম্মান হল খুব  শেষ  জীবনে।  এই ঘটনা না ঘটলে অশোক  হয়ত আরো দশ বছর  চাকরি করতে পারত, ওর দুই সাম্রাজ্যই বজায় থাকত ।  কোন নতুন গ্রান্ট, কোন  নতুন চাকরি আর পাওয়া সম্ভব নয় ওর  পক্ষে । প্রবাসী  বাঙ্গালিরা এবং প্রবাসী  ভারতীয়রা ওকে  এড়িয়ে  চলে। সহকর্মীরা ওর  সঙ্গে যোগাযোগ রাখে না।  শেষ  জীবনটা  অশোকের

একা একাই কেটে  যাবে  মনে হয়। ওর  স্ত্রী  তনুশ্রী কিন্তু বরাবরই ওকে খুব ভালবাসে আর যত্ন  করে। ছেলেমেয়েরা সব বড় হয়ে আমেরিকার অন্য শহরে চলে গেছে, এখন ওরা দুজনে সেই বিশাল বাড়িতে একাই  থাকে।

এগুলো কি হেরা দেবীর শাপের ফল? চল্লিশ বছর পরে ফলেছে?  অশোকের বিয়ে  তো দিব্যি টিকে আছে। সুতরাং আমি বলব এটা  ওর দুর্ভাগ্য, নিজের অহংকারের জন্যই ওকে   বুড়ো   বয়েসে ঝামেলায় পড়তে হয়েছে।  হেরা দেবীর  অভিশাপ আজকাল আর কাজ করে না – দিন কাল বদলে গেছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *