হুনার ক্যাপ্টেন জুনিয়র যশ

হুনার  ক্যাপ্টেন জুনিয়র যশ

কানসাস -এ আমার বন্ধু ছিল  যশুয়া , ডাক  নাম যশ । না,  গবেষক  নয়, অধ্যাপক নয় , আমার প্রতিবেশি, স্থানীয় পাওয়ার প্ল্যান্টে ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করত।  

আমাদের  আড্ডা ভালই জমত, বিয়ার আর স্ন্যাকস নিয়ে বসা হোতো প্রতি  শনিবারে ।  যশুয়া  বা যশ একেবারে টিপিকাল শ্রমজীবী  আমেরিকান,  পড়াশোনা বেশিদূর করে নি, ওই হাই স্কুল পর্যন্ত।    হাই স্কুলেই যশ ওর ক্লাসের  মেয়ে এমির  প্রেমে একেবারে হাবুডুবু। এমিও লটকে গেল, তারপর   দুজনেরি ১৮ বছর বয়েসে  বিয়ে হোল ।  পরপর দুটো বাচ্ছা হয়, বড়টার নাম ছোট (জুনিয়র)  যশ আর ওর ছোট বোনের      নাম  মেরী ।

এই গল্পটা ছোট  যশের জীবন নিয়ে, প্রায় পঁচিশ বছরের ঘটনা ।

যখন ছোট যশের বয়েস  আঠেরো, আমার বয়েস ৩২ আর ওর বাবার বয়েস ৩৭। ওর বাবা ওর সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরন করতে শুরু করল ওই বয়েসেই । বাবা আর ছেলে একসঙ্গে বিয়ার আর সিগারেট খেত, আমিও ওদের  সঙ্গে হামেশাই যোগ দিতাম। যশ ছিল ইলেকট্রিক মিস্তিরি , কিন্তু কত রকম  মেরামতির কাজ যে ও করতে পারত তার ঠিক  নেই – কলের মিস্তিরি, রাজমিস্তিরি,  বাগানের মালী , গাড়ির মেকানিক, – সব কাজের  যন্ত্রপাতিতে  ওর গ্যারাজ  ভর্তি। ছেলেকে সব আস্তে আস্তে শেখাতে শুরু করেছিল  যশ।

ছোট যশের মুখটা একেবারে ছোট ছেলের মতন, দেখে মনেই হয় না ওর ১৮ বছর বয়েস। ওর বয়েসি মেয়েরা ওকে একবারেই পাত্তা দিত না , তাই কয়েক    মাসের মধ্যেই খোকা যশ মুখভরতি দাড়ি আর গোঁফ গজিয়ে ফেলল।    এতে করে ওর অনেক বান্ধবী হল কিনা জানিনা, কিন্তু ওর মুখ দেখে আমার হাসি পেত – ঠিক  মনে হত বাচ্চা ছেলের  মুখে আঠা দিয়ে দাড়ি গোঁফ লাগান হয়েছে।

হাতের কাজ, মিস্তিরির কাজ এসব তো  হোল , তা পড়াশোনার কি হবে? আমরা একদিন মীটিং করলাম, যশ, এমি, ছোট  যশ এবং আমি। সেই প্রথম দেখলাম আমেরিকান বাবা মারা ছেলেকে কিরকম  স্বাধীনতা দেয়।

খোকা যশ বলে, কলেজে  পড়বে না, কোন ইচ্ছে নেই

“তাহলে চাকরি খোঁজ , বাড়িতে  বসে থাকবি নাকি?”  ওর  বাবা বলল।

“বাবা, আমি আমেরিকান পুজিপতিদের  পকেট ভারি করার জন্য  জন্মাই নি। প্রাইভেট সেকটর ফ্যাকটরি  বা অফিসে  কাজ করব না কোনদিন।“  খোকার কি তেজ!

“আর কোনদিন পরিবেশের (environment) দূষণ (pollution) হয়, এরকম কাজ আমি করব না।“ খোকা আমাদের জানাল।

সেদিন এই  পর্যন্ত । মাস খানেক পরে যশ আমাকে জানাল “খোকা প্ল্যান করেছে”!

“সত্যি? কি করতে চায়?”

“একটা ডিপ্লোমা করা যায় ক্রিমিনাল অ্যান্ড লিগাল স্টাডিস , আঠেরো মাস লাগে। ওটাই করবে বলছে।“ যশ জানাল আমাকে। “পুলিশ, নিরাপত্তা রক্ষী, সমাজসেবক, উকিলের সহকারী, এইসব চাকরি হতে পারে।“

“দেখ কি হয়” আমি বললাম “তোমরা ছেলেমেয়েদের  বড় বেশি স্বাধীনতা দাও। আমার ছেলে হলে হাত পা বেঁধে কলেজে পাঠিয়ে দিতাম হাহা!!”

“খোকা তো তবু পড়বে বলেছে ! আমার ষোলো বছরের মেয়ে বলছে  চিড়িয়াখানায়

পশুপক্ষীর সেবা করেই জীবন কাটিয়ে দেবে!!”

‘কি সর্বনাশ! ধরে মারো সব কটাকে, নইলে ঠিক  হবে না!”

এরপরে প্রায় দুই বছর কেটে গেছে। ডিপ্লোমা   শেষ করার পর ছোট  যশ আর ওর বাবা বুঝতে পারল, ওই ডিপ্লোমা দিয়ে বড় শহরে পুলিশের চাকরি হবে না। বড় শহরের পুলিশের  চাকরি পেতে হলে  ক্রিমিনাল সায়েন্সে স্নাতক ডিগ্রি লাগবে, খুব নামকরা শহরে পুলিশের চাকরি পেতে হলে   আবার পুলিশ অ্যাকাডেমিতে ট্রেনিং  নিতে হবে।   আর, দাড়িগোঁফও বোধ হয় কাটতে হবে।

চাকরির খোঁজে বেরিয়ে পড়ল যশ একটা পুরনো গাড়ি নিয়ে, আর বাবার কাছ থেকে কিছু  টাকা ধার করে।  প্রায়  তিন বছর আমেরিকার ছোট শহরগুলোতে ঘুরে বেড়াল ছোট যশ । আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশে যেখানে কম লোক  থাকে  সেখানে ছোট ছোট সব শহর আছে যাদের লোকসংখ্যা দশ হাজারের  থেকে  কম।  সেই সব সহরে  ঘুরে ঘুরে  চাকরির চেষ্টা   চলতে  লাগল ।

 পয়সার অভাব ছিল, অর গাড়িটাও পুরনো , তাই বাবা মাকে দেখার জন্য ক্যানসাসে ফেরে নি বেশিবার। ফোনে  কথা হতো  বাবা মার সঙ্গে, আমার সঙ্গেও হতো মাঝে মাঝে।

ওর ছোট শহরের  অভিজ্ঞতা  খুব একটা সুখের নয়। একবার ফোনে বলল “টেক্সাস প্রদেশে এল সেগুনডো বলে একটা ছোট শহরে পুলিশের কাজ পেলাম কাকু, কিন্ত পুলিশ চিফ মহা শয়তান। মোটে  পাচজন  পুলিশ, সবাইকে চাকরের মতো খাটায়। ওর বাজার করা , বাড়ি সারান,ছেলেমে্যেকে দেখা , এমনকি গাড়ি ধুয়ে পালিশ করা পর্যন্ত সব আমার দায়িত্ব । আমি তিনমাস কাজ করে পালিয়েছি! “

আরেকবার বলল “ নেভাডা প্রদেশের একটা গ্রামে সমাজসেবকের কাজ পেয়েছিলাম। বস একজন বয়স্কা মহিলা, সে সুযোগ পেলেই আমার গায় হাত বুলায়, আর প্রায়ই বলে আমার বাড়িতে   রাতে চলে এস , খুব মজা হবে।

“আমি পালিয়েছি খুব তাড়াতাড়ি !”

আমার খুব হাসি পেল  বললাম “ জিগোলো যশ! ইয়া বেবি!!”

 আরেকটা জায়গায় কাজ পেল, সেখানে একটা কম্পানি কয়েক হাজার বড় গাছ কেটে  দিয়েছে “ওখানে থাকলে আমার খুব ডিপ্রেশন হবে কাকু। ওই কাজও ছেড়ে দিলাম।“

শেষ পর্যন্ত , বাবার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করল, সুদূর  আলাস্কা প্রদেশে যাবে চাকরি খুজতে। চাকরিও হবে আবার অ্যাডভেঞ্চারও হবে। বাবা যশ  ফাইনাল নোটিস দিয়ে দিল ছেলেকে – “আলাস্কাতে কাজ না হলে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবে, কলেজে ঢুকবে । কাকুর কাছে অর্থনীতির    ক্লাস করবে!”

প্রথমে যশ গেল আলাস্কার দক্ষিন পশ্চিমে, যেখানটাকে ইনসাইড প্যাসেজ   বলা হয়।

আলাস্কার পশ্চিমদিকটা  একেবারে অসাধারন। সমুদ্রের ধারেই বিশাল পাহাড়ের দেয়াল। সেখানে জলপ্রপাত, বরফের গ্লেসিয়ার, আর পাইন  গাছের জঙ্গলে হরিন, মুস, ভালুক, বীভার, আরও কত জীবজন্তু। আর সমুদ্রে তিমিমাছ, সিলমাছ, ওআলরাস , অরকা হাঙ্গর আর ডলফিন। লেক আর নদীতে, স্যালমন, trout, bass,  আরও কত  মাছ!

 প্রকৃতি দুই হাত ভরে দিয়েছেন ওখানে। কিন্তু পূর্ব  দিক থেকে যেখানে আলাস্কা এবং ক্যানাডার মেন ল্যান্ড , সেখান থেকে   বিশাল পাহাড়  আর জঙ্গল ডিঙ্গিয়ে  আসার   কোন রাস্তা নেই।

এখানে সব ছোট ছোট শহর (গ্রাম!) আছে –

অদ্ভুত   সব নাম – জুনো, কেচিকান, স্ক্যাগওয়ে , হুনা, মেটলাকাতলা, হাইডাবারগ, এই সব।  হয় নৌকো করে নয় প্লেন -এ করে যেতে হয়, গাড়ি  যাবার কোন  রাস্তা নেই, রেলগাড়িও নেই । শুধু   মৎস্যজীবীরা  এখানে থাকে, কোন কোন গ্রামে হয়ত একটা  মাছের  processing / canning এর কারখানা আছে। সম্প্রতি যে শহর  গুলোতে  বড়  এবং গভীর  বন্দর আছে, সেখানে  বিশাল সব  cruise ship আসতে শুরু করেছে, টুরিস্টরা আসায় তাদের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে।  কিন্তু   হুনাতে  বড়  জাহাজ যায়  না।

হুনার লোক সংখ্যা ৯৩১ ( কলকাতায় আমাদের পাড়াতেই হাজারখানেক লোক থাকে)।

আর  ভীষণ  ভীষণ ঠাণ্ডা, শীতকালে মাইনাস ৪০/৪৫ সেন্টিগ্রেড হামেশাই হয়। শীতকাল নয়মাস ধরে চলে, আর  গরমকালে শুধু বৃষ্টি , আর ৮/১০ ডিগ্রি তাপমাত্রা!

ছোট যশ এই হুনাতে পুলিশ অফিসারের চাকরি পেল, মুখভরতি দাড়িগোঁফ নিয়েই।

একটু গুছিয়ে  নেওয়ার পরে বাবাকে নিমন্ত্রণ  করল, আমাকেও  ফোন করলো একদিন সকালে,

“কাকু আমি যশ  বলছি”

“আরে তুই তো এখন পুলিশ অফিসার হয়ে  গেছিস !! কিরকম লাগছে?” আমি বললাম।

“ফাটাফাটি কাকু! আমি তো ডেপুটি চিফ, আমার বস হচ্ছে চিফ, আর আমাদের সঙ্গে দুজন রুকি (নভিস)  অফিসার আছে,  চারজনের পুলিশ বাহিনী হুনাতে!”

“ ও বাবা ! বিশাল পুলিশের দল দেখছি তোদের! তা  কাজের চাপ কিরকম?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম

“কিছুই না” যশ  বলল “ সপ্তাহের শেষে একটু  মাতলামি করে লোকে । অধিকাংশ লোকই ইনুইত (যাদের আগে এস্কিমো বলত), ওদের মধ্যে ড্রাগের চলন নেই, যদিও মদটা ওরা খায় খুব। শোনো , বাবা আসছে পরের মাসে, তুমিও চলে এস। “

আমি বললাম “ওরে বাবা, প্লেনে করে যাব না একদম। পাঁচটা প্লেনে চড়তে হবে ক্যানসাস সিটি থেকে। শেষ প্লেনটা আবার সিক্স- সিটার । উঠেই আমার মাথা ঘুরে যাবে!

“কাকু, আলাস্কা ফেরীর নাম শুনেছ?  সিয়াটল থেকে ছাড়ে , সমস্ত ছোট  শহরগুলোতে বুড়ি  ছুঁয়ে যায় “

“ওতে যেতে তিন দিন লেগে যাবে। এখন  আর যাব  না যশ, গরমের ছুটিতে  দেখা যাবে।

হুনা শহরটা কিন্তু খুব একটা ভাল দেখতে নয়। দুটো তিনটে পাকা রাস্তা, দুটো ট্রাফিক লাইট। একটা একতলা স্কুল  বাড়ি আর একটা সিটি অফিস, আর কোর্ট আর পুলিসের থানা আরেকটা   বাড়ির মধ্যে।  কিছু বড় গুদমঘর আর  কিছু  ছোট দোকান – এই সব। দুটো রাস্তা আছে  শহর থেকে সমুদ্রে যাওয়ার জন্য। একটা চলে যায় বন্দরে যেখানে মাছের নৌকা আর  জাহাজ আসে, আর একটা উলটো দিকে সমুদ্রের ধারে চলে যায় , সেখানে  একটা  ছোট  ডক আছে , প্রাইভেট নৌকা   সেখান থেকে ছাড়ে । ও ,একটা হসপিটালও আছে শহরে , আর দু তিনটে গ্রসারি/সুপারমারকেট। নিরাশ হবেন না শহরের বর্ণনা শুনে, একটু     চোখ  তুলে পশ্ছিম দিকে তাকালেই অকুল সমুদ্র, আর পূর্বদিকে তাকালে পাইন গাছের জঙ্গল আর  বিশাল বরফের পাহাড় , আকাশে গোল্ডেন ইগল পাখি ঘুরছে, জায়গাটা ভালই!

প্রায় সত্তর শতাংশ অধিবাসী হচ্ছে  ইনুইত, বাকিরা সাদা আমেরিকান। না, কেউ আজকাল ইগ্লুতে থাকে না, সবাইকার ছোট  ছোট  বাড়ি  আছে, তিন কোনা ছাত বাড়িগুলোর । কিছু   লোক আবার  ট্রেলার হোমে  থাকে,  আলুমিনিয়ামের চৌকো বাড়ি, চাকা লাগান, ওগুলো  দেখতে  খুব বাজে।

গরিব কেউ না, কিন্তু  কারুরই বেশী পয়সা নেই। সরকারি চাকরি  বা মাছ সঙ্ক্রান্ত ব্যাবসা, এই করেই চলে আর কি। তিন মাস গভীর  শীতের  সময় মৎস্যজীবীরা নৌকো নিয়ে বেরোতে পারে না। প্রায় সকলেরি  ATV (all terrain vehicle) আছে, যেগুলো তিন চাকা গাড়ি,    মোটা মোটা চাকা লাগানো , এগুলো  নিয়ে জঙ্গলে যায় বা বরফ জমা সমুদ্রের ওপরে  চলে যায়। আর, প্রত্যেক বাড়িতেই  মস্ত বড়  freezer আছে, সেখানে গরমকালের ধরা  অনেক কিলো মাছ আর হরিন বা গরুর মাংস জমানো থাকে শীতকালে  খাওয়ার জন্য।

হুনা সহরের একই  পাড়ায় দুটো ছেলে ছিল – ম্যাক্স আর  নীল । ম্যাক্স  নীলের থেকে  বয়সে প্রায় চার বছরের বড় , কিন্তু ম্যাক্স   প্রতিবন্ধী , ওর  মাইলড অটিসম ছিল। অটিসম যাদের  থাকে তারা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না, সিরিয়াস অটিসম থাকলে কথা বলতেও শেখেনা, দেয়ালের দিকে  মুখ করে বসে থাকে। মাক্সের অটিসম অত খারাপ ছিল না।

 বেশি  বয়েসে ম্যাক্স  হাই স্কুলে পড়ত নীলের  সঙ্গে,  একই ক্লাসে । ম্যাক্স -এর ব্যাবহার এমনিতে  স্বাভাবিক , শুধু সব কিছুই আস্তে আস্তে করত, আর লোকের সঙ্গে কথা বলতে চাইত না। লোকের মুখের দিকে চেয়ে কথা বলতে পারত না। উত্তেজিত হয়ে গেলে ভীষণ চেঁচাত, আরও বেশি রাগ হলে হাতের কাছে যা পেতো তাই ছুঁড়ে মারত।  

হাই স্কুলের কয়েক বছর  পরে নীল  হুনাতে রুকি ( শিক্ষানবিস)  পুলিশের চাকরি পেল।

পুলিশের গাড়ি , সাইরেন, বন্দুক, টেসার গান (taser, এগুলোকে stungun বলে, লোককে     অবশ এবং   অকেজো করে দেওয়া যায় ) পুলিশের ওআকি টকি  রেডিও, আবার পুলিশ বডি

  ক্যামেরা – যত নতুন খেলনা!  নীল খুব খুশী। খুব উৎসাহের সঙ্গে হুনার রাস্তায় টহল দেয় গাড়ি  নিয়ে – আইন রক্ষা করতে হবে না! মাঝে মাঝে চেনাশোনা বয়স্ক লোককে রাস্তায় দাঁড়  করায়,  একটু গল্প করে, বলে “সাবধানে গাড়ি চালাবেন কাকু”। 

সুন্দরী ১৬/১৭ বছরের মেয়েরা, যারা  সবে গাড়ি চালাতে শিখেছে , তাদের দেখলে নীল গাড়ির সাইরেন বাজিয়ে দাঁড় করাত। মাঝে মাঝে তাদের লাইসেন্স চেক করত আর প্রচুর প্রশ্ন করত। মেয়েরা পুলিশ চিফের কাছে কমপ্লেন করার পরে  এটা  একদম  বন্ধ করে দিতে হোল – হায় হায়!

ওর বন্ধু ম্যাক্স একটা কাঠের গোলায় চাকরি পেল। কাজ খুব সাধারন, ঠেলাগাড়ি  করে কাঠ  নিয়ে যাওয়া , লরি থেকে মাল নামান ওঠানো ,  করাত দিয়ে কাঠ কাটা এইসব আর কি।

বেচারি ম্যাক্স-এর পেছনে নীল খুব লাগত হাই স্কুলে পড়ার সময়   থেকেই ।, হাঁদা বলে ডাকতো , গালাগাল দিত,, ওর বান্ধবী নেই বলে আওয়াজ দিত – এইসব ! নীল পুলিশের চাকরি পাওয়ার পরে এই হ্যারাসমেনট আরও বেড়ে যায় । কিন্তু কেউই ভাবে নি নীল আর মাক্সের ঝগড়ার এইরকম সাংঘাতিক পরিনতি হবে।

কি ঘটেছিল আমি নিজের চোখে দেখিনি। একদিন বিকেলবেলা ছোট যশ খুব উত্তেজিত হয়ে ওর বাবাকে ফোন করে। আমাকেও সেইদিন রাতে  ফোনে সব কথা বলে দেয়।

ঘটনাটা ঘটে শনিবার সকালে। তার আগেরদিন, শুক্রবারের সন্ধ্যায়, মাক্সের দুটো কুকুর প্রচণ্ড ঝগড়া আর মারপিট  করতে শুরু করে।  দুটোই হিংস্র পিট বুল কুকুর, শেষ পর্যন্ত একটা কুকুর মারা যায় ।       প্রচণ্ড কুকুরের চিৎকার আর  মাক্সের বাড়ির লোকেদের  চিৎকার , পাড়ার লোকেরা  পুলিশ দেকে দেয় । নীল সাইরেন বাজিয়ে ওর  গাড়ি  নিয়ে আসে, তারপর ম্যাক্সকে খুব গালাগাল দেয়, বলে নিজের কুকুরদের সামলাতে পারিস না বোকাচো —-।  শান্তিভঙ্গের জন্য, হিংস্র জন্তু বাড়িতে  রাখার জন্য, আরও কিসব  অজুহাতে, অনেক টাকা  ফাইন -এর নোটিস  ধরিয়ে  দেয় ম্যাক্সের হাতে। মাক্সের খুব রাগ হয়ে যায় , কিন্তু ও চুপ করে থাকে

পরের  দিন, শনিবার , মাক্স কাঠগোলায়  কাজ করতে যায় সকালে। একটা বড় লরিতে করে কাঠ ডেলিভারি দিয়ে ড্রাইভার চলে গেছে। মাক্স লরিটাকে নিজেই চালিয়ে দোকানের সামনে নিয়ে আসে।  একটা ছোট ফর্ক লিফট  ট্রাকে করে লরি থেকে মাল নামাচ্ছে। এমন সময়   নীল এসে গেল সাইরেন বাজিয়ে আর ভীষণ হুজ্জুতি শুরু করে দিল। প্রথমেই বলল লরিটা ভুল জায়গায় পার্ক করা  হয়েছে তার জন্য   জরিমানা হবে কারন লরিটা বড় রাস্তার ট্রাফিক   আটকে  দিচ্ছে।  তারপর বলল ফর্ক লিফট   ট্রাকটা রাস্তার ওপর পার্ক করা হয়েছে তার জন্য জরিমানা হবে, আর হ্যাঁ যত কাঠ নামান হয়েছে লরি থেকে, সেগুলো ফুটপাতের ওপরে রাখা হয়েছে, তার জন্যও ফাইন দিতে হবে।

আর সমানে মাক্সকে গালি দিচ্ছিল  নীল ।

“দ্যাখ গাড়োল , তোর একদিনের কাজের ফাইন দিতে  তোর সাতদিনের মাইনে খরচা হয়ে যাবে হাহা”

ভাগ্য ভাল, যে এর একটু  আগেই নীল ব্যাক আপ -এর জন্য  ফোন  করে, যশ  ওর গাড়ি  নিয়ে সাইরেন বাজিয়ে চলে আসে।

যশ গাড়ি থেক নামার আগেই হটাত ম্যাক্স ভীষণ খেপে গিয়ে ওর নিজের গাড়ির দিকে ছুটে  গেল। নিমেশের মধ্যে একটা  শট গান নিয়ে এসে নীলকে গুলিকরে। নীলও সঙ্গে সঙ্গেই ওর টেসার   গান  ছুঁড়ে মাক্সকে    অবশ  করে দেয়।

যশ গাড়ি থেকে নেমে দেখে, মাক্স যন্ত্রণায়  ছটফট  করছে, মুখ দিয়ে ফেনা  বেরচ্ছে। আর নীল ডান  হাতের ওপরের দিকটা  ধরে বসে আছে, খুব রক্ত বেরচ্ছে ।

মাক্সএর স্নায়বিক আঘাত লেগেছিল এই টেসার থেকে,, কয়েক সপ্তাহ হাস্পাতালে ছিল।   নীলের গুলির আঘাত খুব একটা  খারাপ হয় নি, ওকে  দুদিন বাদে  হাস্পাতাল থেকে ছেড়ে  দেয়। 

ঘটনাটা ঘটে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যে, কিন্তু এর ফল হল সাঙ্ঘাতিক।  আমেরিকা মহা

মাম্ লাবাজ দেশ আর এই ঘটনায় লাইন দিয়ে উকিলরা এসে  গেল।  হুনা শহর, হুনার পুলিশ কর্তৃপক্ষ, মাক্সের পরিবার, নীল, আর জুনিয়র যশ, সবাই একে অপরকে নানা কারনে অভিযুক্ত  করে দিল। মাক্সের পরিবার হুনা সহরের, পুলিশের, নীলের আর যশের  বিরুদ্ধে মামলা করল পুলিশ brutality-র  অভিযোগে , আবার নীলের পরিবার  মাক্সের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার (attempted murder)  অভিযোগ  আনল। 

 হুনার শহর আর পুলিশের  বিরুদ্ধে নীল আর যশ  অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করার মামলা আনল কারন ঘটনার পরেই পুলিশ চিফ নীল আর যশকে সাসপেন্ড করে দেয়।  আরও একাধিক মামলা হল এইসব নিয়ে, আমার অত মনে নেই।  জজ সাহেবের হুকুমে প্রথমে ফৌজদারি মামলার নিস্পত্তি  হল, তারপর অন্য কেসগুলোর শুনানি শুরু হল।

 ওই সময় আমাদের যশ খুব কষ্টে কাটিয়েছে ।  চাকরি চলে গেছে, হুনার স্কুলে সিকিউরিটি গার্ডের পারট  টাইম  কাজ করে, জমান টাকা আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আলাস্কা প্রদেশের সরকার একটা বেকার ভাতা দিত, সেটা  নিয়ে কোনরকমে চলে যেত।

আমি   ফোনে  একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, “অনেক হয়েছে, এখন বাবা মা্র কাছে চলে এস না কেন?”

“অনেক মামলা একসঙ্গে চলছে কাকু” যশ  জানাল , “আমি একমাত্র আই উইটনেস , তাই সব  মামলাতেই আমার সাক্ষী দেওয়া ম্যানডেটরি , না গেলে পুলিশে ধরে জেলে রেখে দেবে।     ক্যানসাসে  ফিরে যাওয়া এখন সম্ভব নয়।“

“মামলাগুলো সব চুকে গেলে এখানে  চলে আসবে তো” আমি প্রশ্ন করলাম।

“বলা যায়না  কাকু” যশ  আমাকে জানাল  “  হুনাতে আমার উকিলের অফিসে এক সহকারী (প্যারালিগাল)  কাজ করে, আমি ওকে বলি প্যারালিগাল প্রিনসেস ।  মেয়েটিকে  আমার খুব পছন্দ।

“এই মরেচে” আমি হাসতে  হাসতে  বললাম “ উকিলের অফিসে এইসব কি হচ্ছে কি?”

“এখনও কিছু হয় নি কাকু, ক্রমশ প্রকাশ্য”

তা প্রায় দুবছর লেগে গেল সব মামলা চুকতে । তারপর একদিন যশের  ফোন এল

“ কাকু, সব কেস চুকে গেছে, আমি বেক্সুর খালাস, , আর হুনা সহর আমাকে গত দবছরের মাইনে, আর একটা থোক টাকা ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে!”

আমি ত শুনে খুব খুশি । বললাম “ ভাল করে সিনিয়র যশের সঙ্গে পরামর্শ কর এখন  কি করবে। গাঁজা খেও না বেশি!”

“কে কাকে বলছে? তুমি তো রোজই খেতে। আজকাল কমিয়েছ?” যশ আমাকে খোঁচা মারল। তারপর বলল “ আমার এক নতুন অ্যাডভাইসার   হয়েছে,  প্যারালিগাল প্রিনসেস -এর বাবা। “

ওর সঙ্গে ব্যাবসায় নামব  ওই ক্ষতি পূরণের টাকা নিয়ে।

এই কথা হয়ার  কিছুদিন  পরে ইন্টারনেটে একটা নোটিস  দিল যশ সব সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে।

            RIDE THE INUIT PRINCESS (BOAT)

            LEAVES FROM THE BEAUTIFUL PORT OF HOONAH, ALASKA

            THE BEST WHALEWATCHING TRIPS IN ALASKA

            WHALE SIGHTING GUARANTEED OR YOUR MONEY  BACK

            CALL CAPTAIN JOSH JUNIOR : XXX-XXX-XXXX

WHALEWATCHING আমেরিকায় খুব জনপ্রিয়, যশ এইসব শুরু করে দিল নাকি? আমি উত্তেজিত হয়ে ওকে ফোন করলাম।

“কি সব হচ্ছে কি?”

“বলছি সব” যশ বলল “আমার বান্ধবীর বাবা আর আমি একটা নৌকো কিনেছি। নৌকোর ডেকের  ওপর  দশ পনের জন লোক  বসতে  পারে,  তা ছাড়াও বিশ্রাম  করার  দুটো  ঘর আছে  , একটা রেস্ট রুম আছে, একটা মিনি কিচেন আছে। আমেরিকায় আনেক বড়লোক   আছে, তারা অপরিচিত অজানা জায়গায় যেতে  চায়, তাদের নিয়ে তিমিমাছের পাল দেখতে যাব । আমার পার্টনার এখানে বহুদিন নৌকো চালিয়েছে, ও সব গোপন  জায়গা  জানে যেখানে বড় জাহাজ যেতে পারেনা, সেখানে পাঁচ দশটা  বা কখনো এমনকি তিরিশ চল্লিশটা  হাম্পব্যাক হোয়েল একসঙ্গে খেলা করে, মেলামেশা করে। বড় লরির সাইজের অনেক তিমিমাছ একসঙ্গে  জল থেকে লাফাচ্ছে, ছবি নিশ্চই দেখেছ,। একবার  দেখলে আর ভোলা যায় না।

পয়সাওয়ালা  আমেরিকানরা এইরকম বোট ভাড়া করে  এডভেনচার করতে চায়, অনেক টাকা  দিতে রাজি থাকে আর খুশি হলে অনেক টাকা  টিপস দেয় । সপ্তাহে তিন চারটে  ভাড়া  পেলেই আমার চলে যাবে ভালভাবে, হাতে অনেক জমেও যাবে ।  শীতকালে ওই  জমান টাকা  দিয়েই চলবে , দরকার হলে  প্যারালিগালের ঘাড়ে চেপে খাব হাহা।“

“ভাল প্লান হয়েছে” আমি বললাম। “বাবা কি বলে”?

“বাবা আসছে শীঘ্রই  , খুব উত্তেজিত এইসব শুনে”

“আমিও আসার চেষ্টা করব?” আমি বললাম।

  তারপরে আর     যাওয়া হয় নি। কিন্তু খবর পাই  ছোট যশ  এখন বড় ক্যাপ্টেন হয়েছে, ব্যাবসা ভালই চলছে। ভাবা যায় না, পুরনো  গাড়ি নিয়ে যে কাজের খোঁজে সারা দেশ ঘুরে বেড়াতো ,  তার এইরকম অবস্থা   হবে।

পরিশ্রমের কাজ, অনেক ঝামেলা আছে, অনেক রিস্কও নিতে হয় মাঝে মাঝে।  ছোট যশের  বয়েস প্রায় চল্লিশ হল, কিন্তু এই বয়েসেই দাড়ি সব পেকে গেছে। হাসিটা কিন্তু  সেই  ছোটবেলার  মতই আছে।

প্যারালিগাল প্রিন্সেসের সাথে বিয়ের ঠিক হয়েছে। আমার  আর পাপা যশের নেমত্তন্ন। সিয়াটল শহর থেকে  ফেরী বোটে করে যাব, যেতে তিন দিন লাগবে। আর বিয়ের পরে ছোট  যশের  সঙ্গে 

WHALEWATCHING করতে যাব !

এই সুযোগ  ছাড়লে চলবেনা !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *