পাঁঠারসিক পরশ বাবু – a story in Bengali

পাঁঠারসিক পরশ বাবু

 আমরা বাঙ্গালীরা পাঁঠা ভালবাসি খুব। রবিবারের কলকাতার সকালে অনেক বেচারা পাঁঠা দেহ রাখে যাতে আমাদের  মধ্যবিত্ত  বাঙ্গালীর দুপুরের ভোজটা একটু জমজমাট হয়।

কিন্তু আমেরিকায় সুপারমার্কেটে পাঁঠা পাওয়া যায় না। ওরা  অনেক বিফ খায়, শুওরের মাংসও খায়। যদি খুব বড় শহরে থাকেন, সেখানে অনেক প্রবাসী লোক থাকে , যারা Jamaica, Puerto Rico, এসব দেশ থেকে  এসেছে। ওরাও পাঁঠা ভালবাসে খুব, আমি Jamaica-র লোকেদের  রেস্টুরেন্টে একবার মাটন খেয়েছিলাম , খুব ভাল খেতে।

 ওই সব দেশের লোক  বা বাংলাদেশীদের বিশেষ খাবারের দোকান থাকলে সেখানে মাটন পাবেন। কিন্তু আমেরিকার অন্য   শহরে পাঁঠা পাওয়া দুষ্কর।

 প্রায় তিরিশ বছর আগে আমেরিকার যে খুদে শহরে আমরা থাকতাম সেখানেই পরশ বাবুর সঙ্গে আলাপ হয়ে ছিল। অনেক দিন ইন্ডিয়াতে ভাল চাকরি করতেন, তারপর ছুটি নিয়ে এসেছিলেন  পি এইচ ডি করার জন্যে। আমি যদিও অধ্যাপক, আর উনি ছাত্র,  আমাদের বয়েস মোটামুটি একই , এই ৩৫/৩৬ হবে আর কি।মাঝে মাঝে আড্ডা হত। লোকটা  ভাল, কিন্তু মাথায় সবসময় নানারকম ধান্দা ঘুরছে।

একদিন বলল

“ জানেন তো , আমার বাবা মা বেড়াতে এসেছেন দেশ থেকে। ইলিশ মাছ ত পাওয়া যায়  না, ভাবছি একদিন পাঁঠা কিনে ওদের যদি খাওয়ানো  যায়”।  

আমি তো একদম না করে দিলাম।  “ এখানে মার্কেটে কত রকম  সবজি, চিকেন, ভেড়া সব পাওয়া যায়, বেশি পয়সা  দিলে ভালো চিংড়ী মাছ পাওয়া যায়, খাওয়াদাওয়া ত ভালই হয় নিশ্চয়ই , কেন আর  পাঁঠা খুঁজে সময় নষ্ট করবেন? জানেন ত এখানের দোকানে  ওসব পাওয়া যায় না”।

পরশ বাবুর উৎসাহ কম নয়। উনি বললেন “ এখান থেকে প্রায় ২০ কিমি দূরে একটা কসাইয়ের দোকান আছে গ্রামের মধ্যে, সেখানে অনেক রকমের মাংস বিক্রি করে। চলুন না রবিবার সকালে, যদি পাঁঠা  পাওয়া যায়”।

রবিবার সকালে আমি গাড়ী চালিয়ে ওর সঙ্গে দোকানটাতে চলে গেলাম। পাঁঠা পাওয়া গেল না।

“অনেক হয়েছে, চলুন বাড়ী যাই”, আমি বললাম।

পরশ বাবু ছাড়বার লোক নয়।  দোকানের সব কর্মচারীকে ধরে ধরে প্রশ্ন করতে লাগলেন “এখানে কোথায় গোট মিট পাওয়া যাবে জানেন”?

ওদেরই একজন বলল “ এখান থেকে দশ কিমি দূরে একটা  গ্রামে জীবজন্তু নীলাম হয় প্রতি রবিবার সকালে। সেখানে মাঝে মাঝে পাঁঠাও থাকে”।

“চলুন যাই” পরশ একপায়ে খাড়া।

আমি একটু অবাক হলাম, “ যতদূর শুনেছি ওই  সব জায়গায় চাষিরা গরু বাছুর, শূয়র এইসব নীলাম  করে তো, পাঁঠা আবার কে আনবে” ? তারপর জ্যান্ত পাঁঠা নিয়ে আপনি কি করবেন”?  

“সে আমি ব্যাবস্থা করে নোবো, আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না, আগে চলুন না” ওনার উৎসাহের আর শেষ নেই।

সত্যি কথা বলতে কি, ওনার  প্রতিশ্রুতি খুব একটা সুবিধের মনে হোল না । আমি পেশায় অধ্যাপক, জন্তু জানোয়ারের সংগে খুব একটা মেলামেশা হয় না, যদিও ছাত্রদের মধ্যে কিছু পাঁঠা তো  সবসময়েই দেখতাম।

কৌতূহলের বশে চলে  গেলাম আরো দশ কিমি গাড়ী চালিয়ে। বড় একটা মাঠের ওপরে অনেক চাষি  তাদের গাড়ী,  ট্র্যাক্টর, ছোট লরি এই সব পার্ক করে রেখেছে। পাশে বিরাট তাঁবু খাটিয়ে নীলাম হচ্ছে।

গরু বাছুর, শূয়র এই সবই বেশী দেখা  গেল, তাঁবুর বাইরে এক জায়গায় তাদের রাখা হয়েছে, নম্বর ডেকে   ডেকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া  হবে নীলামের জন্যে।

মাঠের অন্য দিকটা কিন্তু একদম চিড়িয়াখানা!! আমরা তো দেখে অবাক! বোঝা গেল, চাষিরা বাড়ীতে অনেক জন্ত জানোয়ার পোষে সখ করে, সেইগুলো থেকে আবার মাঝে মাঝে কিছু বিক্রি করে দেয়। দেখলাম Turkey মোরগ, এমু পাখি, লামা, আলপাকা, খরগোস, ময়ূর ,  ইগুয়ানা  আরও কত কি!   কত রকমের পাখিও রয়েছে  নীলামের জন্যে ।

পাঁঠা ? তাও ছিল। দুটো Angora goat, একদম সাদা ! বড় বড় লোম গায়ে, কি সুন্দর দেখতে –ইউরোপের জন্তু।  

পরশ বাবুর জিভে জল আসে আর কি!  “এগুলো খেতে একদম ফার্স্ট ক্লাস হবে দাদা”!

আমি বললাম “ আপনি কি পাগল হয়েছেন! এদের লোম  থেকে খুব দামী পশম হয় , ইউরোপে তার সোয়েটার  বিক্রি হয় প্রচুর দামে। এ কেউ খায় নাকি? একটা  ছাগল প্রায় ১০০০০ টাকা দাম হবে, বা আরও বেশী !”

 এই কথা শুনে পরশ বাবু দমে গেলেন একটু ।

(২০২১ সালে আমি ইন্টারনেটে Angora সোয়েটার বা মহেয়ার সোয়েটারের দাম চেক করলাম, ইউরোপে ফ্যান্সি দোকানে বিক্রি হচ্ছে ২/৩ লক্ষ টাকা  দামে। আবার চীনেরা ওই  একই জিনিস ৬/৭ হাজার টাকায় বিক্রি করছে। জাল Angora গোট না জাল সোয়েটার না ধাপ্পাবাজি কিছু বুঝলাম না!!)

তবে কয়েক মিনিট পরেই একটা লরি এল, তার পেছন থেকে দুটো কচি ছাগল তড়াক করে  এক লাফে নেবে এল। পরশ বাবু কি খুশী !

তাঁবুর মধ্যে  ঢোকা  হোল । একটা বড় গ্যালারীতে সব ক্রেতারা বসে আছে, তলায় একটা  টেবিল, সেখানে কাগজপত্র আর একটা  হাতুড়ী নিয়ে বসেছে নীলামদার আর তার সহকারী।

এক এক করে পশু আসে , আর গালারির ওপরে বসা ক্রেতারা হাত তোলে যদি দাম পছন্দ  হয়। আস্তে আস্তে দাম বাড়তে থাকে, যখন একজনও হাত তুলছে না, তখন সব থেকে বেশি দামের ক্রেতাকে বেচে  দেওয়া হয়। দাম ঠিক  হলে  হাতুড়ী মারা হয় একবার, মানে নীলাম শেষ, পরের আইটেম মিয়ে এস।

তা আমরা গ্যালারীর অনেক ওপরে  বসেছিলাম। প্রথম ছাগলটা  এলো , লোকে দাম বলতে শুরু করলো , কিন্তু পরশের দিকে কেউ নজর দিলো না, চটপট আর একটা লোক ছাগলটা কিনে নিলো  

পরশ বাবু ক্ষেপে খেলেন খুব। ছুটে তলায় গিয়ে নীলামদারকে কি বকুনি “ আমরা মজা করতে আসিনি, আমাদের দিকে একটু নজর রাখবেন স্যার”

আর একটা  ছাগল এলো । কেউ খুব একটা উৎসাহ দেখাল  না। আর আমরা একদম কিনে নিলাম তাকে ২৩ ডলারে ।

আর তারপরেই যতো  গণ্ডগোল !

কিছুক্ষণ পরে, টাকা জমা দিয়ে, আমরা তখন পারকিং এর মাঠে আমার গাড়ীর পাশে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশে গর্বিত পরশ বাবু পাঁঠার দড়ি ধরে আছেন, আর পাঁঠাটা ব্যা ব্যা করছে।

“হুম, এবারে কি করা হবে?” আমি প্রশ্ন করলাম।

একটু আমতা আমতা করে উনি বললেন “ আচ্ছা বলছি কি, আপনার গাড়ীতে যদি ওকে চাপিয়ে কসাইখানায় নিয়ে যান , তা হলেই হবে”।

আমি এই শুনে  তেলে বেগুনে চটে গেলাম “এই আপনার প্ল্যান ছিল? আমার গাড়ী খুব পরিষ্কার , কোন গন্ধ নেই। ওখানে পাঁঠা ঢুকলে এখুনি হিসি করবে, আরও কি করবে বুঝতেই পারছেন। দু বছর সেই গন্ধ থেকে যাবে । আমার আমেরিকান সহকর্মী কাউকে গাড়ি চড়ালে সে ভাববে আমারি গায় পাঁঠার গন্ধ! ছি ছি !!

“আমি সব পরিষ্কার করে দোবো, কথা দিচ্ছি, প্লিস।“

“ বললেই হোল, পাগল নাকি, কোনও পাঁঠা আমার গাড়ীতে ঢুকবেনা”!

তারপর আমি বললাম, খুব শান্ত গলায় “ দেখুন,  আপনার দুটো অপশন আছে । এখান থেকে পাঁঠাকে নিয়ে হেঁটে যান কসাইখানায় , দশ কিমি দূরত্ব , দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবেন !! অথবা আমি এখন ২০ কিমি গাড়ী চালিয়ে বাড়ী যাবো, সেখানে খুঁজে দেখবো কোন প্রতিবেশীর ছোট লরি আছে কিনা। যদি থাকে, তিন ঘণ্টার  মধ্যে ফিরে আসবো একদম।, আপনি এখানে অপেক্ষা করুন, পাঁঠার সঙ্গে গল্প করেই সময়টা  কাটিয়ে  দেবেন ।

এইশুনে পরশ বাবুর মাথা খারাপ হয়ে গেল।

যে গেট দিয়ে লরিগুলো বেরিয়ে যাচ্ছিল, সেখানে দড়ি হাতে  ধরে পরশ বাবু দাঁড়িয়ে গেলেন। একটা করে লরি বেরোয়  আর পরশ বাবু তাকে থামিয়ে কি কাতর অনুরোধ “ দাদা, আমার পাঁঠাকে একটা  লিফট দেবেন আপনার লরিতে” ?

আমি জীবনে খুব কমই অত হেসেছি। মোটাসোটা  এক  বাঙ্গালী বাবু, ঘামতে ঘামতে, পাঁঠার দড়ি  ধরে  এক গাড়ী থেকে আর এক গাড়ীতে যাচ্ছেন ছুটে ছুটে, হাঁপাতে হাঁপাতে, আর পাঁঠাটা সমানে ব্যা ব্যা করে ডেকে  চলেছে। এরকম দৃশ্য আমেরিকায় আমি কোন দিন  দেখিনি।  আমেরিকান চাষিরা কেউ অবাক হল, কেউ মজা পেল , সবাই ওকে  কাটিয়ে গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল। পরশ বাবু আস্তে আস্তে মুষড়ে পড়ছেন দেখলাম। হায় ভগবান!

আমার পেটটা হাসতে হাসতে প্রায় ফেটে যায় আর কি! কিন্তু ভগবান আছেন!

একটা  ভাঙা ঝড়ঝড়ে লরি করে ভগবানের উদয় হোল। দেখতে একদম আমেরিকান চাষিদের মতো।খোঁচা খোঁচা দাড়ি, নোংরা ওভারঅল , সামনের দাঁত অর্ধেক নেই।

 ভগবান বললেন “ অবশ্য আপনার পাঁঠা নিয়ে যাব। তবে ট্যাক্সি ভাড়া  লাগবে” !

ছুটে  গিয়ে পরশ বাবু পাঁঠাকে তার লরিতে তুলে দিলেন। মুখে একগাল হাসি ! আমার কাছে এসে  বললেন “ দাদা  আমি ওই  লরিতে  চেপে  যাচ্ছি, আপনি পেছনে পেছনে আসুন”।

আমি বললাম “ওই  ঝড়ঝড়ে গাড়ি চড়া কেন , ওতে এসি পর্যন্ত  নেই, এই গরমে কষ্ট করার  কি  দরকার”?

“যদি আমার পাঁঠা নিয়ে ও  ভেগে পড়ে” ?

আবার আমার হাসি পেলো “ও আপনার ছোট একটা  পাঁঠা চুরি করে জেলে যাবার ঝুঁকি নেবে, আপনি পাগল নাকি”?

‘কাউকে বিশ্বাস নেই দাদা , সাবধানের  মার নেই”! পরশ বাবুর ভগবানের অপর বেশি আস্থা নেই দেখলাম।

পাঁঠার ট্যাক্সি ঠিকই পৌঁছল কসাইখানায়। কিছুক্ষণ পরে আমরা দুজনেই হাতে একটা করে বড়  বাক্স নিয়ে বাড়ির দিকে যাত্রা করলাম। প্রত্যেকের ভাগে সাড়ে সাত কিলো কচি পাঁঠার মাংস। সাংঘাতিক ভাল খেতে। আমরা খেলাম, অন্যদের নেমন্তন্য করে খাওয়ালাম, অনেক সপ্তাহ আর মাংস কেনার দরকার  হয় নি।

খরচা কত হল? তিরিশ বছর আগে, পাঁঠার দাম ২৩ ডলার, ট্যাক্সি ৩ ডলার, কসাই  ৯ ডলার আর ৬০ কিমি গাড়ি চালানোর জন্যে তেল, আর নীলামঘরের দুটো  টিকিট এক ডলার। যদি প্রশ্ন করেন ২০২১ সালের  কলকাতার টাকায় এর মূল্য  কত হবে, সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেওয়া শক্ত হবে।কারন দেখতে হবে আমেরিকায় তিরিশ বছরে  কত মূল্যবৃদ্ধি  হয়েছে, ইন্ডিয়াতে কত মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, তারপর ডলার/রুপি বিনিময়ের হার কতটা বদলেছে – একটা ছোট গবেষণা পত্র লিখতে হবে আর কি!

তা না করে সোজা উত্তর দিচ্ছি, যা মোট খরচা হয়েছিল ১৫ কিলো মাংসের জন্যে, আমেরিকায়  ১৫ কিলো চিকেন কিনতে ওই সময় অন্তত আড়াই গুন বেশি পয়সা লাগত। সুতরাং পরশ বাবু সত্যিই আমাদের অনেক পয়সা বাঁচিয়ে  দিয়েছেন সেদিন।

মাস দুয়েক পরে  পরশ বাবু ফোন  করলেনঃ

“জানেন আমার ছোট গাড়িটা বেচে একটা ছোট লরি কিনব ভাবছি। সবজি পাইকারি কেনা যাবে, আসবাবপত্র যন্ত্রপাতি এই সব আনতে কোন ঝামেলা হবে না”।

আমি হাঁসতে হাঁসতে বললাম, “আর মাঝে মাঝে পাঁঠাও কেনা যাবে! তবে ছেলে মেয়ে, বউ ওদের নিয়ে চলাফেরা করবেন  কি করে? এ তো  ইন্ডিয়া নয়, লরির পেছনে বাচ্ছাদের চাপালে পুলিশ বিরাট ফাইন করবে”।

“ওই আমি লরি চালাব, আর পাশের সিটটায় তিনজন গাদাগাদি করে বসে যাবে আর কি”। এটা  বলার পরে পরশ বাবু আবার    নিজেকেই  শুধরে  নিলেন ।

“না দাদা, ও সব  হবে না, বউ এসব  শুনলে চটে  বোম হয়ে যাবে”  

পরশ বাবু পাঁঠা রসিক হতে পারেন, কিন্তু বুদ্ধিমান লোক।

বউকে চটিয়ে পৃথিবীতে কোন  কাজই হয় না !!

2 Replies to “পাঁঠারসিক পরশ বাবু – a story in Bengali”

Leave a Reply to pronto7852@yahoo.com Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *