কিপটে কাকুর জিপসি প্রেম ঃদ্বিতীয় পর্ব

কিপটে কাকুর জিপসি প্রেম ঃ দ্বিতীয় পর্ব

রতনের প্রেম পর্ব শোনার আগে গাড়ী পর্বের কথা শুনুন। আমরা তখন ১৫/২০ হাজার ডলার দিয়ে নতুন গাড়ী  কিনছি , যারা পয়সা বাঁচাতে চায়, তারা অন্তত তার  অর্ধেক দিয়ে ভাল  secondhand গাড়ী কিনছে। কিন্তু রতন ওদিকে  মোটেই গেল না।

আমাকে একদিন সকালে ফোন “ জানিস এখান থেকে তিরিশ মাইল দূরে  একটা ছোট    শহরে শনিবার সকালে গাড়ীর  নিলাম হয়? চল দেখে আসবি”।

কৌতূহল বশত ওর সঙ্গে গেলাম শনিবারে – ও মা, এ তো দেখি গাড়ীর কবরখানা!

সারি সারি প্রায় দুশো গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে – ক্রেতার সন্ধানে। প্রত্যেক গাড়ীর সামনের কাঁচে একটা করে সাইন লাগান। তাতে একটা দাম আর গাড়ীটার বিশেষ  “গুণ” লেখা আছে।

“BMW 1985 – no engine – $200!”

“Toyota 1990 – no seats, no tires, $600!

Cadillac 1998 –  no headlights,  no battery, $700

দাম লেখা আছে যেটা  সেখান থেকে নীলাম সুরু হবে। মনে রাখবেন, যা  লেখা আছে  তা ছাড়াও গাড়ীর অন্য সমস্যা থাকতে পারে – যেমন  যে গাড়ীর ইঞ্জিন আছে সেটা যে স্টার্ট করবে তার কোন  মানে নেই !!

আমার ওই সব গাড়ী কেনার কোন ইচ্ছে  হোল না, কিন্তু রতন ওখানে নিয়মিত যাওয়া শুরু করে দিলো।  একটা  গাড়ী কিনল ৬০০ ডলার দিয়ে, সেটাকে সারালো আবার ৫০০ ডলার খরচা  করে – সেই গাড়ী নাকি ছয়মাস দিব্বি চলছে ।

“প্রায়ই  ওখানে যাচ্ছি “ আমাকে ফোনে বলল রতন।

“কেন রে? গাড়ী তো  কেনা হয়ে গেছে!”

“আ রে এইসব গাড়ী যে কোন দিন ভেঙ্গে যেতে পারে, আমি গিয়ে দেখে আসি    বিকল্প কিছু পাওয়া যাবে কিনা “।

রতন চালু ছেলে !  সব প্ল্যান করে চলে।

কিন্তু অন্য একটা  কারণও ছিল। ওখানেই একদল লোকের  সঙ্গে দেখা হয় – বয়স্ক জেমস, আর ওর  দুজন ছেলেমেয়ে, কুড়ি     বছরের  সিয়ারা আর প্রায় তিরিশ বছরের  টমাস। ওরাও পুরনো গাড়ীর ধান্দায়  ওখানে যেত। ওরাও রতনকে  বলেছিল আমেরিকানরা বোকা, মিছিমিছি পয়সা নষ্ট করে নতুন গাড়ী  কিনে। ওরাও খুব কিপটে মনে হোল – রতনের এটা খুবই পছন্দ  হয়েছিল।

ওদের গায়ের রং সাদা লোকদের  থেকে  এক্টু চাপা। “তোমরা মেক্সিকান?” রতন ওদের জিজ্ঞাসা করল ।

“না, আমাদের বাবা মা পূর্ব ইউরোপ থেকে এসেছে , অনেকদিন আগে।“ সিয়ারা বলল

জেমস দুপুরের খাওয়ার জন্য রতনকে  নেমত্তন্ন করল এর পর। খেতে গিয়ে রতনের চক্ষু চড়কগাছ । ময়দার গোলা  সেদ্ধ, তার ওপরে টক দই, আর আলু সেদ্ধ   নুন দিয়ে – কি কিপটে রে বাবা!

রতন পরের সপ্তাহে ওদের খাওয়াল –  রুটি আর চিকেনের  ডানা আর ঘাড়ের মাংস  ! – সস্তার খাবার কিন্তু মশলা দেওয়া, ওদের থেকে অনেক ভাল ।

খাবার পরে,  টেলিভিশনের সামনে বসে জেমস একটা একটা করে প্রায় হাজারখানেক সিগারেট খেলো, আর টমাস ওর  ভিডিও গেম -এর  কনসোলে শুধু খেলতে লাগলো । সিয়ারা কিন্তু ওর সঙ্গে গল্প করে আর মিটি মিটি হাসে । একটু পরে সিয়ারা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

চোখের  কোণ দিয়ে রতন দেখল, একটি সুন্দর মেয়েলি হাত ওকে  হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ওই   হাতছানি ফলো করে রতন পৌঁছে গেল ওর ফ্ল্যাটের একচিলতে বারান্দাতে ।   তিনতলার  ওপরে ছোট বারান্দা। সিয়ারার খুব পছন্দ হয়েছে মনে হোল । “ কি সুন্দর দেখাচ্ছে নিচের রাস্তাটা ! আমাদের ফ্ল্যাটে কোন বারান্দা নেই, জানলা দিয়ে শুধু সামনের বাড়ি দেখা যায় “।

ছোট্ট বারান্দা, সুন্দর  ভিউ, সুন্দর মেয়ের পাশে গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রতন, এইভাবেই ব্যাপারটা শুরু হল।  পরের সপ্তাহে আবার খেতে ডাকল  ওদের – এবারে চিকেনের মেটে আর কাবুলি ছোলা – একটু বেশী খরচাই হয়ে  গেলো  রতনের। এইবারে সিয়ারা ওর ফ্ল্যাটটা পুরো ঘুরে দেখতে চাইলো , আর দেখতে দেখতে রতনের শোবার ঘরে পৌঁছে গেল ওরা দুজন – রতনের বিছানাটাও সিয়ারার খুব পছন্দ হোল ।

এইরকম চলল কিছুদিন ধরে। ওরা তিনজনে এসে রতনের খাবার খায়, তারপর জেমস সোফায় বসে সিগারেট খায় আর টমাস ওর পাশে বসে ভিডিও গেম খেলে। আর সিয়ারা আর রতন  ওপরের তলার শোবার ঘরে চলে যায় ।

কিছুদিন পরে রতন জিজ্ঞাসা করল “রোজ রোজ তোমার   বাড়ীর  লোকদের  নিয়ে আস  কেন? আমরা ঠিকমত একা হবার সুযোগ পাই না।“

সিয়ারা হেসে বলল “ ওপরে  আমি তো  একাই যাই তোমার সাথে, তাই না? ওদের আমি নিয়ে আসি কারণ আমাদের রাতের খাবারের খরচা বেঁচে  যায় । আমাদের  বাড়ির কেবল টি ভি ক্যানসেল করে দিয়েছি, আর সন্ধ্যে বেলায় আমাদের  বাড়িতে আলো জলে না। কত পয়সা বেঁচে যায়   জান?

এই চরম কিপটেমির কথা শুনেই রতন একেবারে প্রেমে পড়ে গেল। একে বিয়ে করলে দুজনে মিলে কত টাকা জমানো যাবে! একেবারে জীবনসঙ্গিনী!

এইবার অঞ্জলিকে “এক্স-পারটে” (একতরফা) ডিভোর্স দেবার সময় হয়েছে, অঞ্জলির কলকাতার টাকার কোন  দরকার নেই আর!  

অনেক ভেবে রতন একটা  ছোটোখাটো হীরের আংটি কিনল । সিয়ারা খুব খুশী হয়ে বিয়ের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেল।

আমরা বন্ধুরাও খুব খুশী হলাম রতনের জন্যে।  

“এই শোন, আর কতদিন টাকা কোলে করে বসে  থাকবি?”  আমরা রতনকে  খোঁচা মারতে শুরু করলাম। “আমরা দশ বছর আগে নতুন গাড়ী কিনেছি। তুই শুধু  আলফাল ভাঙ্গা গাড়ী চালিয়ে এতদিন কাটালি। নতুন বউএর সাথে একটু আনন্দ করবি ত? একটা নতুন গাড়ী কেন আর একটা  বড় ফ্ল্যাট ভাড়া কর। অনেক কিপটেমি  করেছিস!”

রতন আমাদের কথা শুনে রাজি হয়ে গেল । এখন ভাবি, কেন এসব আইডিয়া দিলাম । চুপচাপ থাকলেই ভাল হত!

রতন আর সিয়ারা অনেক প্লান করে সব ঠিক করল। গাড়ীর জন্য সিয়ারা প্রায় ২৫% টাকা দিল। ঠিক হল দুজনের নামেই গাড়ীর TITLE হবে।

নতুন  হণ্ডা গাড়ী কেনা হয়ে গেল। নতুন একটা  বড় ফ্ল্যাট  ভাড়া   করা হোল, তিনটে বেডরুম , মস্ত বড় বসার ঘর।

একদিন, শুভ বৃহস্পতিবারে সবাই রতনের পুরনো  ফ্ল্যাটে জড় হল। জেমস আর টমাস রতনকে জানাল যে ওরা ওদের পুরনো ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে রতনের ফ্ল্যাটে চলে আসবে। একটা লীস সই করে রতনকে  দিয়ে দিল, প্রতি মাসে রতনকে ওরা ভাড়া দেবে।

সিয়ারা বলল “ আজ আর কাল আমরা আমাদের পুরনো ফ্ল্যাট থেকে সব জিনিস  এখানে নিয়ে আসব। গাড়িটা আমি দুদিন রেখে দিচ্ছি এইসব কাজের জন্যে।

তোমাকে এখন আমাদের নতুন ফ্ল্যাটটা , যেখানে আমি আর তুমি থাকব, সেখানে ছেড়ে আসছি। শনিবার সকালে, আমি তোমার সঙ্গে দেখা করবো । তোমার কিছু পুরনো জিনিশপত্র আমি নিয়ে আসব সঙ্গে করে। তারপর আমরা সব নতুন ফার্নিচার কিনতে বেরবো। আমি তোমার সঙ্গেই থাকব তারপরে।

রতন শুক্রবারে ট্যাক্সি করে অফিস গেল আর ফিরে এল। রাতে নতুন ফ্ল্যাটে মনের আনন্দে ঘুমিয়ে পড়ল। কাল থেকে ওর সুখের দিন শুরু হয়ে যাবে!।

ওমা শনিবার সকাল  থেকে সিয়ারার ফোন বন্ধ হয়ে গেল। অন্যদের ফোনও বন্ধ।

ওই শনিবার  রতনের ভাল কাটলোনা । বলা যায় খুবই খারাপ কাটল । দুপুর বেলা একটা ট্যাক্সি করে রতন ওর পুরনো ফ্ল্যাটে গেল প্রেমিকার খোঁজে। কি আশ্চর্য , সেখানে কিছু অচেনা লোক ঢুকে  বসে আছে। ওরা জানালো যে জেমস ওদের এই ফ্ল্যাটটা ছয় মাসের জন্য সাব -লীস করে গেছে, অগ্রিম ভাড়াও নিয়ে    নিয়েছে ছয় মাসের জন্যে। শুনে রতনের মাথায় হাত।

 আস্তে আস্তে সব ব্যাপারটা পরিস্কার হোল। ওই  প্রায় ৪৮  ঘণ্টা সময়ের মধ্যে, সিয়ারা এবং তার পরিবারের লোকেরা রতনের সব আসবাবপত্র বেচে  দিয়েছে, সোফা, টেবিল, আলমারি, কম্পিউটার, টি ভি বিছানা, সব কিছু । জেমস রতনের এই ফ্ল্যাটটা ছয় মাসের জন্য সাব -লীস করে গেছে, অগ্রিম ভাড়াও নিয়ে    নিয়েছে ছয় মাসের জন্যে। রতনের নতুন গাড়ীও সিয়ারা বেচে  দিয়েছে।   এইসব করে এখন  ওরা হাওয়া !! কোথায়  গেল?

দুদিন পরে সিয়ারাই ফোন করল – হাওয়াই  থেকে – “ ডার্লিং আমরা হনলুলুতে একটা ফ্ল্যাট  নিলাম। জেমস আমাকে বিয়ের প্রস্তাব করেছে। সমুদ্রের ধারে বিয়ে হবে, খুব মজা।“

রাগে রতনের কথা প্রায় বন্ধ হয়ে আসে আর কি “ কি বলছ? জেমস  তোমার  প্রেমিক? বাবা নয়? টমাস তাহলে কে?”

সিয়ারা হেসে বলল “ আমরা জিপসি মেয়ে ডার্লিং। আমাদের একাধিক বয়ফ্রেন্ড থাকে। ওরা  দুজনেই আমার প্রেমিক।  তুমিওত আমার বয়ফ্রেন্ড ছিলে । তোমার সব সাহায্যের  জন্য ধন্যবাদ, টাকাগুলো  কাজে লাগবে। তোমার আংটিটা দিয়ে আমার বিয়ে হবে। আর, বলতে ভুলে গেছি, তোমার ভিসা কার্ড দিয়ে তিনটে প্লেনের টিকিট  কাটা  হয়েছে হাওয়াই যাওয়ার জন্যে। তোমার বাড়ি থেকে, তোমার কম্পিউটার দিয়ে কাটা  হয়েছে টিকিটগুলো, ব্যাঙ্কের কাছে নালিশ করে কোন লাভ হবে না।  টা টা !!”

রাগে কাঁপতে কাঁপতে রতন ফোন ছেড়ে  দিল।

পরের দিন এক উকিলের কাছে গিয়ে সব খুলে বলল রতন। উকিলবাবু সব শুনে মুখ চাপা দিয়ে খুব কাশলেন, মনে হল হাসি চাপার চেষ্টা করছেন।

“শুনুন স্যার “ উকিলবাবু বললেন “ এরা সব ইউরোপের জিপসিদের বংশধর মনে হচ্ছে। এরা গত সাতশ বছর ধরে প্রতারনার কারবার করছে। আপনাকে ওরা অনেক প্ল্যান করে ধরেছিল। কি করলে আপনি রাজি হবেন , কি করলে ওদের বিশ্বাস করবেন সব ওরা হিসাব করে নিয়েছিল। এমনকি আপনার সঙ্গে যেখানে আলাপ হয়েছিল গাড়ি নীলামের জায়গায়, সেটাও কাকতালীয় নয়।“

“মামলা করে আপনার পয়সা নষ্ট হবে। “criminal fraud” প্রমান করা যাবে না, “civil fraud” প্রমান করে একটা ক্ষতিপূরণের রায় পেতে পারেন, কিন্তু টাকা আদায় করতে আবার মামলা করতে হবে, প্রায় দশ বছর কেটে যাবে। ভেবে দেখুন কি করবেন”।

রতন কিছুই করল না। ক্ষতি হল অনেক, নতুন গাড়ি, সব  ফারনিচার, টেলিভিশন,  কম্পিউটার, ছয় মাসের বাড়িভাড়া, হিরের আংটি্‌ – রতনের মত কিপটে  লোকের বুক ভেঙ্গে যাবার মত! আমরা আর রতনের পেছনে লাগিনা। বেচারা!  আর্থিক    ক্ষতি ছাড়াও ও মানসিকভাবে খুব আঘাত পেয়েছে –সিয়ারা যে এরকম করবে তা ও ভাবতেই পারেনি।

কিন্তু অঞ্জলি রতনকে ছেড়ে দেয় নি। ছেলেটা এখন বড় হয়েছে,  ওকে কলকাতার সব থেকে দামী স্কুলে

ভরতি করার জন্য টাকা চায় রোজই!

ও বাবা। ছেলে তো রতনের নয়। কিন্তু তা প্রমান করতে হলে কলকাতার কোর্টে গিয়ে ডি এন এ পরীক্ষা করতে হবে! ততদিন পর্যন্ত অঞ্জলিকে টাকা দিতেই হবে!

কি কাণ্ড!!