ডুলুথে প্রাতরাশ

ডুলুথে  প্রাতরাশ

আমেরিকার উত্তরে লেক সুপিরিয়র। খুব ছোট  লেক নয়। এই ১৫০০ কিলোমিটার লম্বা আর ১৫০০ কিলোমিটার  চওড়া , মোটামুটি ওটা একটা সমুদ্র। অ্যাটলান্টিক মহাসাগর থেকে বিশাল সব জাহাজ চলে আসে , আমেরিকার গম, কয়লা, লোহা এসব  নিয়ে যায় । ডুলুথ  সহরটা   এই লেকের ধারে, খুব গভীর এক  বন্দর আছে এখানে।  ছোট্ট  সহরের ধারে দৈত্যের মত   বড়  বড় জাহাজ পার্ক করা থাকে, বন্দরের ধারে রাক্ষসের  খেলনার মতো মস্ত সব পাইপে করে জাহাজে মাল তোলা  আর নামান হয়। কয়লার  পাহাড়, গমের পাহাড় তৈরি হয়ে যায় বন্দরের পাশে।

মধ্য আমেরিকার অর্থনীতিক থিয়োরি গ্রুপের  কনফারেন্স করতাম আমরা বছরে দুবার। নিউ ইয়র্ক , ক্যালিফোর্নিয়া , এইসব জায়গায় বড় সব কনফারেন্স হয়, প্রচুর ভিড়  হয়ে যায়। নামকরা সব  অর্থনীতিবিদরা  আসে,   আমাদের মত চুনোপুঁটিদের  আবস্থা কাহিল হয়ে পড়ে।

সুতরাং আমরা ছোট সহরে এই  বাচ্ছা  কনফারেন্স করতাম যেখানে আমাদের গবেষণা  নিয়ে   নির্ভয়ে অনেক  কথা বলা যায় । এক এক  বার এক  একটা  সহরে হতো । ২০০৩ সালে হয়েছিলো ডুলুথ সহরে।

সহরের মাঝখানে সব প্রশাসনিক এরিয়া আছে, সেখানে বড় বড়  সব হোটেল  আছে, সেখানেই  ডুলুথ হিলটন হোটেলে আমাদের মিটিং হচ্ছে। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই  ওই  আধুনিক বড়  হোটেলে  ঘর  নিলাম না।  

বন্দরের প্রধান চ্যানেলের ধারে পুরনো কিছু পাথরের বাড়ি । কতকগুলো বন্দরের অফিস, কতকগুলোকে নিয়ে একটা শপিং মল খোলা  হয়েছে , আর একটা পুরনো পাথরের বাড়িতে উনবিংশ শতাব্দীর একটা হোটেলকে সংস্কার করে একটা আধুনিক “বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট”  খোলা হয়েছে , সেখানেই আমি একটা ঘর নিলাম। ঘর খুব ছোট, আসবাবপত্র একশো বছরের  পুরনো , দেওয়ালে  পুরনো দিনের জাহাজের আর বন্দরের ছবি, গোল গোল  জানলা জাহাজের মত।

শুক্রবার সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে, কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ডুলুথের হিলটন হোটেলে পৌঁছলাম । সেখানে সারা বিকেল মিটিং করে, সন্ধ্যেবেলা   চ্যানেলের ধারে আমার হোটেলে  ঢুকলাম । লবিতে দেখি সমিধবাবু দাঁড়িয়ে  আছেন ।

সমিধ বাবু পড়ান নেব্রাস্কা প্রদেশের  একটা বড়  কলেজে। ওনার গবেষণার জন্য উনি অনেক উঁচু লেভেলের অংক করে অর্থনৈতিক  সমস্যার বিশ্লেষণ করেন। আমি খুব সম্মান করি ওনাকে, কিন্তু ওনার  অংক  অনেক সময়েই ভাল বুঝিনা। সব সময়ই ওনার  মন  নিজের কাজের মধ্যে ডুবে থাকে, তাই এই   হোটেলে  ওকে দেখে বেশ অবাক হলাম।

“ কিরকম আছেন সমিধবাবু? আপনি হিলটন হোটেলে  থাকছেন না?”

ঊনি একটু দুঃখের সঙ্গে বললেন “ না, তাড়াতাড়ির মধ্যে ঘর রিসারভ  করতে ভুলে গিয়েছি, এখন সকলের থেকে দূরে এই  বাজে হোটেলে  থাকতে হবে, কি ঝামেলা বলুন ত?”

“হিলটনে আমার সহ-লেখক , সহ- গবেষক সবাই আসছে, ওদের  সঙ্গে কাল সকালের আগে দেখা হবে না – সময়টা একেবারে নষ্ট হোল। “

“এখান থেকে বন্দরে জাহাজের আনাগোনা দেখা যায় , আজ রাতে ওই দেখেই সময় কাটিয়ে  দিন না? আমি বললাম।

“ না না, এখন সময় নেই, পরের সপ্তাহে দুটো নতুন পেপারের  সারসংক্ষেপ জমা দিতে হবে। আমি  ঠিক করলাম  যে এখনই  হিলটন হোটেলে  ফিরে যাব  , আমার সহ লেখকদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। রাতে এখানে ঘুমাতে আসব।“ ওনাকে  খুব  ব্যাস্ত মনে হল।

“ঠিক  আছে “  আমি বললাম “ এখানে সকালে ফ্রী  ব্রেকফাস্ট দেবে, মনে করে খেয়ে  যাবেন ।  হিলটন হোটেলে এক কাপ কফির দামই  পড়বে  ৪০০ টাকা।

উনি চলে যাবার পরে দেখলাম সন্ধ্যে সাতটা বাজে। এখানে রাত সাড়ে  নটা পর্যন্ত সূর্যের আলো থাকে গরমকালে। চমৎকার আবহাওয়া। হোটেলের লবিতে মালিকের সঙ্গে আলাপ হোল । না,

গুজরাটি  প্যাটেল নয়, এনার নাম সেরগে, রাশিয়া থেকে আসা অভিবাসী (immigrant).  । বেশ বড় চেহারার  লোক,  ভারি রাশিয়ান  একসেন্টে    ইংরাজি বলেন , শুনলে ভয় ভয় করে। উনি বললেন লবির এক কোণে একটা মিটিং রুম আছে, সেখানে প্রাতরাশ দেওয়া শুরু হবে সকাল সাড়ে  সাতটা থেকে।

হোটেলের  পাশেই শপিং মল । যখন অটোমেশন হয় নি, জাহাজের ডকে অনেক লোক  কাজ করত মাল  তোলা  আর নামানর জন্য, এখানেই তারা কাজ করত। এখন আমেরিকান পুঁজিপতিরা এর চেহারা বদলে দিয়েছে। গিফট শপ, সুভেনির  শপ, টয় শপ, আর তার সঙ্গে জামার দোকান , জুতোর দোকান , আরও  কত কি!!  আর হারবার উইংস বার, হারবার পিজ্জা, হারবার  চিকেন, হারবার ক্যান্ডি  – মাথা খারাপ হবার জোগাড়।  মোটে দুটো পুরনো দোকান  দেখলাম, একতলায় একটা দুশ বছরের পুরনো  কাঁচা মাছের দোকান, সামনেই লেক, সেখান থেকে সোরডফিশ, পারচ, সোল, ব্যাস এইসব ধরে বিক্রি হচ্ছে, একেবারে ফ্রেশ! আর দোতলায় একটা বহু পুরনো রেস্টুরেন্ট , সেখানে শুধু মাছভাজা আর আলুভাজা বিক্রি হয়।  সাংঘাতিক ভাল  ভেটকির   (sea bass) ফ্রাই  খেলাম ওখানে।

তিনতলায় একটা জাহাজের মিউসিয়াম আছে, পুরনো  জাহাজের অনেক যন্ত্রপাতি রাখা, অনেক বাচ্ছা সেখানে ভিড়  করেছে, মিউসিয়ামের সামনেই  একটা  বড় টেরাস, সেখান থেকে চ্যানেলে জাহাজ আসা দেখা যায় – একদম সামনে থেকে, মনে হয় হাত দিয়ে জাহাজগুলোকে ছোঁয়া যাবে।  চ্যানেল প্রায় ১০০ ফুট চওড়া , কিন্তু জাহাজ প্রায় ৮০ ফুট চওড়া, আর আমরা ৩০ ফুট  দূর থেকে দেখছি , আমাদের নাকের পাশে দশ তলা উঁচু জাহাজ চলে যাচ্ছে । আধুনিক জাহাজগুলোয় লোক নেই একবারে,  সেই অনেক উচুতে ব্রিজের ওপর ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে  আর একজন কর্মচারী  ডেকের ওপর  স্প্রে  দিয়ে পরিস্কার  করছে।

আমরা , বাচ্ছা এবং  বড়রা অনেক  ক্ষণ ধরে  টেরাস থেকে জাহাজ দেখলাম,  আবার হোটেলের  ঘরে  গিয়ে দেখলাম জানলা দিয়ে দিব্বি জাহাজ দেখা যাচ্ছে ।  রাত্রি দশটার  পরে সব অন্ধকার হয়ে গেল, দুর্ঘটনা যাতে  না হয় সেজন্যে অত বড় সব  জাহাজ  সব আলো জ্বালিয়ে দিল বন্দরে ঢোকার  সময়, দেখতে সাংঘাতিক লাগছিল, কিন্তু   এত  উজ্জল  আলো  যে রাতে শোবার সময়  জানলা বন্ধ করে পরদা টেনে  দিতে হল। 

পরের দিন সকালে উঠে ঠিক  করলাম আজকে মোটে ফাঁকি  দেব না,  তাড়াতাড়ি  চানটান    করে সোজা  চলে গেলাম  প্রাতরাশের ঘরে। ওমা, ফ্রি বলে একেবারে বেসিক ব্যাবস্থা, ডিম  নেই বেকন  নেই , প্যানকেক নেই, ফলও নেই! একটা  টেবিলে  সাদা স্লাইস ব্রেড, কয়েক প্যাকেট কর্ণফ্লেক ,টি ব্যাগ , আর গুঁড়ো কফি, আর দুধ।

 কম বয়সী  এক দম্পতি  ছিল  প্রাতরাশের  তত্তাবধানে , চেহারা দেখে মেক্সিকান মনে হল।  সেনর (ভদ্রলোক )  আমি যাওয়া  মাত্রই  লাফ দিয়ে একটা বড়  ব্যাগ নিয়ে এল

“সরি স্যার, আমার সাপ্লাই সব শেষ হয়ে গেছে, বাজার থেকে ফল, কেক, জুস, এইসব নিয়ে আসছি এক্ষুনি

এই বলে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে প্রায় ছুটে  পালিয়ে গেল।

ঘরে আমি আর  সেনোরা। ভাল করে দেখলাম, মেয়েটাকে খুব সুন্দর দেখতে, বেশি লম্বা নয়,  কিন্তু  বয়েস কম, ফিগার একেবারে ফাটাফাটি । একটা পাতলা কাপড়ের     ডীপ  ভি-নেক ব্লাউস পরেছে , আর টাইট জীনস , তার জন্য খুবই যাকে বলে, বুঝতেই পারছেন হি হি !!

একটু গল্প করতে ইচ্ছা তো হোলই । কিন্তু গোড়াতেই গণ্ডগোল – সেনোরা একবর্ণ ইংরাজি বলতে পারে না। যাই বলি না কেন, শুধু সি সি বলে আর সুন্দর হাসি দেয়।

হুম, প্রাতরাশের কি হবে? সেনোরা     টেবিলের ধারেই  দাঁড়িয়ে আছে । ওই  ত আমাদের খাবার দেবে, কিন্তু কি করে বুঝবে আমি কি চাই?

প্রথমে ভাবলাম , ইশারা  করে দেখিয়ে  দোবো, কিন্তু  তাতে ঠিক হবে না মনে হোল।  

মনে মনে দুর্গা দুর্গা বলে চলে গেলাম টেবিলের ধারে, সেনোরার  উল্টো    দিকে।  চোখ  বড় বড় করে উনি আমাকে না না বললেন অনেক বার, আরও কত কি বললেন স্প্যানিশ ভাষায় রাগ করে! একদম  পাত্তা না দিয়ে আমি  পাউরুটির প্যাকেট খুলে  দুটো  স্লাইস  টোস্ট করতে দিলাম, একটা কর্ণফ্লেকের প্যাকেট খুললাম, আর  গরম জলের কেটলিতে জল গরম করে কফি করে নিলাম। ব্যাস, প্রাতরাস হয়ে গেল। সেনোরা হাসি বন্ধ করে দিয়ে রাগ রাগ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, , আমি ফিক ফিক করে  হাসতে হাসতে সব খাবার খেয়ে নিলাম।

খাবার পরে একটু চ্যানেলের ধারে ঘুরে এলাম, এই পনেরো কুড়ি  মিনিট  হবে। ফিরে এসেই লবিতে  সমিধ বাবুর সঙ্গে দেখা। ভীষণ উত্তেজিত!

“গুড মর্নিং”, আমি বললাম , “ খেয়েছেন সকালে?”

“ কি বলব মশাই” উনি বললেন” প্রাতরাশের ঘরটাতে একটি  মেয়ে কাজ করে, একদম অকর্মণ্য। আমার একটু  ক্লরেসটেরল বেশি আছে, তাই আমি  ওই মেয়েকে বললাম একটা লাইট হুইট ব্রেড টোস্ট করে দাও, আর স্কিম মিল্ক আর গ্রীন টি দাও। ও শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল আর বিদেশি ভাষায় কি সব বলতে লাগল। যত সব !!”

“সে কি?” আমি বললাম “ আমি তো  নিজেই ব্রেকফাস্ট বানিয়ে  খেয়ে নিয়েছি কিছুক্ষণ আগে। ওই মেয়েটার  বর  তো  দশ মিনিট  পরেই ফিরে আসার কথা ছিল , সে ভালই ইংরাজি বলে।“

“তা আমি জানিনা, আমার ভীষণ রাগ হয়ে গেল, আমি সোজা গিয়ে ফ্রন্ট ডেস্কে ওর  নামে কমপ্লেন করে দিলাম” উনি খুবই  রেগে আছেন মনে হল।

“ফ্রন্ট ডেস্কে কে ছিল ? একটা রাশিয়ান লোক ? সেরগে?” আমি প্রশ্ন করলাম।

এই কথার পরেই শুনলাম ফ্রন্ট ডেস্কের সামনে থেকে খুব চ্যাঁচামেচি। গিয়ে দেখি,  সেনর আর অর বউ সেরগের কাছে ক্ষমা চাইছে , সেনর সবে বাজার থেকে ফিরেছে , হাতে  প্রাতরাশের খাবারের থলে।

সেরগের মুখ রাগে লাল, ইংরাজি আর রাশিয়ান দুই ভাষায় অনেক গালি দিলেন সেনরকে। শেষকালে বললেন” তোমাদের এখানে আর কাজ করার দরকার নেই, বেরিয়ে যাও এখান  থেকে এই মুহূর্তে।“

সেনর মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে দরজার দিকে হাঁটতে সুরু করল, তার পাশেই  সেনোরা একদম ছোট মেয়ের মতো অঝোরে কান্না শুরু করে দিল। প্রচুর অশ্রুপাত হল, ওর  জামার সামনেটা ভিজে গিয়েছিলো একেবারে। আমরা অবাক হয়ে  চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখলাম।

ওরাও চলে গেল, আমরাও যে যার আলাদা গাড়ি  চালিয়ে হিলটন হোটেলে চলে গেলাম।   শনিবার সারাদিন কনফারেনস হল। রবিবার সকালে, আমার হোটেলের প্রাতরাশের   ঘরে তালা বন্ধ,  কি আর করা যাবে, হিলটন হোটেলে গিয়ে ৪০০ টাকার  কফি আর ১৫০০ টাকার টোস্ট  আর ডিম ভাজা  খাওয়া হোল – যত শালা চোর !সকালে দুঘন্টা একটা ফেয়ারওয়েল সেশন হোল, ভাল ভাল সব স্পিচ শুনে সবাই গাড়ি চালিয়ে  বাড়ি চলে এলাম।

আসার সময় আর একবার সমিধবাবুর সঙ্গে কথা হোল । “ওই  প্রাতরাশের লোকগুলোকে   ছাড়িয়ে   দিল কেন বলুনতো?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।

“কে জানে, ওরা  অবৈধ  নাগরিক বোধ হয়,  চোরও হতে পারে। যতো সব বিদেশী অশিক্ষিত লোক! “ উনি নিজের কমপ্লেনের কথা ভুলেই গিয়েছেন  দেখলাম।  বোঝো!

আমিও খুব একটা ভাল লোক  নই। ওই  দম্পতির জন্য আমার দুঃখ একেবারে হল না। শুধু সেনোরা যখন  কাঁদছিল , প্রচুর অশ্রুপাতের  ফলে ওর  পাতলা  জামার সামনেটা কিরকম ভিজে গিয়েছিল  ভি-নেক যে কিরকম আকর্ষণীয় দেখাচ্ছিল , সেই নিয়েই চিন্তা  করছিলাম গাড়ি  চালিয়ে বাড়ি  আসার পথে।  

আমেরিকা আর পুঁজিবাদী  অর্থনীতি  আমাদের বদলে দিয়েছে ।

অনেক বস্তা অনুভূতিপ্রবণতা (sensitivity) নিয়ে ইন্ডিয়াতে বড়  হয়েছি। সে সব কোথায়  গেল?