গুগুষার গপ্পো
আমরা বাঙ্গালিরা (এবং ভারতের লোকেরা) দুর্নীতি , চুরি, আর ভণ্ডামি অনেক দেখেছি। এই তো গত বছরের জুলাই মাসে, পশ্ছিম বাংলার শিক্ষা মন্ত্রির বান্ধবীর বাড়িতে পঞ্চাশ কোটি টাকা ক্যাশ উদ্ধার করা হোল
আর এই মাসে সন্দেশখালির মস্তানকে ধরা হয়েছে যে প্রায় পুরো সহরটাই তার বাপের জমিদারি করে ফেলেছিল। আরও কতো কোটি টাকা চুরির গল্প রোজই বেরোয় টিভিতে তার ঠিক নেই। পুকুরচুরি ছাড়াও
রোজই আপনার চোখের সামনেই বিভিন্ন সরকারি প্রোজেক্ট থকে চুরি হয়ে যায় , স্কুল, হসপিটাল, রাস্তা সারান , পার্ক ও উদ্যান রক্ষা সব কিছুর থেকেই একটা ভাগ দাদাদের কাছে চলে যায়। এছাড়াও চাকরি পেতে ঘুষ, ধার পেতে ঘুষ, বাড়ি তৈরি করতে ঘুষ, কতো আর বলব।
এত রকম দুর্নীতি ভারতে আছে যে আমরা বিদেশের দুর্নীতির ঘটনাকে খুব একটা পাত্তা দিই না। কিন্তু
গুগুষার গপ্পো আপনাদের ভাল লাগবে, নতুন অনেক মজার কথা শুনবেন ঃ
গুগুষা (ভাল নাম গুলনারা) পড়াশোনায় বড় ভাল ছিলেন । উনি প্রথমে কলেজ থেকে একটা স্নাতক ডিগ্রি পান “আন্তর্জাতিক অর্থনীতি” বিষয়ে । তারপরে উনি আমেরিকা চলে যান । সেখানে প্রথমে New York -এর Fashion Institute of Technology থেকে ডিসাইন-এ একটা ডিগ্রি করেন। তারপরে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে Regional Science -এ একটা Master’s degree করেন (হাহাহা!)
এরপরে বিদুষী দিদিমণি নিজের দেশে তাশখন্দ ইউনিভার্সিটিতে ফিরে আসেন। সেখানে political science -এ একটা পি এইচ ডি করে ফেলেন। ব্যাবসার সুবিধে হবে বলে আবার একটা স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে নেন Telecommunications -এ।
হাঁপিয়ে গেছেন নাকি? বিদুষীর পেশা কি ছিল? তা উনি হচ্ছেন উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্টের মেয়ে – কারিমভের মেয়ে গুলনারা কারিমভা । এতসব ডিগ্রি পেয়ে উনি তাশখন্দ ইউনিভার্সিটিতে পলিটিকাল সায়েন্সের অধ্যাপক ছিলেন। তাছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক এজেন্সির আধিকারিক হিসাবে প্রশাসন দপ্তরেও ওনার বিরাট প্রতাপ ছিল।
উজবেকিস্তান ছোট দেশ ইন্ডিয়ার তুলনায় – ওদের জনসংখ্যা সাড়ে তিন কোটি , আর আমাদের ১৩৫ কোটি !!
লোকজন অনেকেই বেশ গরিব, ফ্যাশনেবল দামী জামাকাপড়ের ক্রেতার সংখ্যা কম। কিন্তু এই ছোট মার্কেট পুরো কন্ট্রোল করেন গুগুশা দেবি। সমস্ত ফ্যাশনেবল দামী জামাকাপড়ের ডিসাইন উনি নিজেই করেন, বাইরে থেকে এগুলো আমদানি করা বারণ। আর যেসব দোকানে ওই কাপড় বিক্রি হয়, তার মালিকও হচ্ছে গুগুষার কম্পানি।! ডাবল মনোপলি যাকে বলে।
উজবেকিস্তান ছোট দেশ , তাই একটাই মোবাইল ফোন কম্পানি ছিল, সেটার শেয়ারের সিংহভাগ আবার গুগুশা দেবীর হাতে!
প্রাইভেট মিডিয়া , টিভি , নিউজ পেপার ,তাও গুগুশার নিয়ন্ত্রনে!
উজবেকিস্তানের পুরনো হসপিটালগুলো ফ্রি, কিন্তু ভাল চিকিতসা হয় না, অনেক নতুন প্রাইভেট হসপিটাল খোলা হয়েছে স্বাধীনতার পরে। ওমা গুগুশার কম্পানির সেখানেও গরিষ্ঠ মালিকানা আছে।
(যদি কারো সন্দেহ হয়, আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি এই সব ডিগ্রি গুলো দুনম্বরি আর ব্যাবসা গুলো মালিকদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা বা লুট করা !!)
দিদির প্রতিভার শেষ নেই। অত অধ্যাপনা, গবেষণা, আর প্রসাশনিক কাজের মধ্যেও উনি সময় করে নাচ গান এইসব করেন। ওনার নিজেরি একটা রক ব্যান্ড আছে, সেখানে ওনার লেখা গান গেয়ে উনিই পারফরম করেন। এইসব শো ইউরোপের নামকরা সহরে দামী হল ভাড়া করে দেখান হয়, অনেকেই শুনতে আসে (হাহাহা)। আসবেই তো ! গুগুশার সোনালি চুল, মিষ্টি হাসি, আর বাংলায় যাকে বলে ফাটাফাটি এনডাওমেনট , এইসবের টান কি এড়ানো যায় ? যদি ইচ্ছে হয়, ইউ টিউবে দেখবেন দিদিকে, নিজের গানের তালে নিজেই নাচছেন, কি সুন্দর!!
দিদির বাবা কারিমভ কাকুর কথা একটু শুনুন এবারে। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ল , মধ্য এশিয়া আর পূর্ব ইউরোপে অনেক নতুন দেশের জন্ম হোল । ইসলাম কারিমভ উজবেকিস্তানের অত্যাচারী ডিকটেটর হিসাবে তার একনায়ক তন্ত্র চালিয়ে গেলেন পঁচিশ বছর ধরে। সোভিয়েত স্টাইলের নিয়মে সব অর্থনৈতিক কাজের ওপরই নিয়ন্ত্রন ছিল , পারমিট লাগত, ট্যাক্সও দিতে হত। বিদেশ থেকে জুতো আমদানি করলেও ট্যাক্স, আবার এদেশ থেকে কাপড় রপ্তানি করলেও ট্যাক্স। একটা নেটওয়ার্কের পকেটে এই ট্যাক্সের ভাগ চলে যেত। এই নেটওয়ার্কে প্রথমে ছিলেন কারিমভ কাকুর সাঙ্গপাঙ্গরা , পরে আমাদের গুগুশা দিদিই এর নেত্রী হয়েছিলেন।
দেশের লোকের প্রতি কারিমভ কাকুর খুব একটা সহানুভুতি ছিল না – ওদের থেকে কাজ আর টাকা আদায় করলেই উনি খুশি। ওনার ক্ষমতার অপব্যাবহারের একটা বড় উদাহরন দিচ্ছি ঃ উজবেকিস্তানে প্রচুর তুলোর চাষ হয়। যখন তুলোর ফসল কাটার সময় হয়, তখন একই সঙ্গে অনেক শ্রমিকের দরকার হয়ে পড়ে। তাই কাকু ফতোয়া জারি করলেন যে ওই সময় দুমাস স্কুল কলেজ সব বন্ধ থাকবে।
সমস্ত ছাত্রছাত্রীরা, শিক্ষকরা অধ্যাপকরা, প্রশাসকরা , স্কুল কলেজের অন্য কর্মচারীরা, সবাই (মোট দশ লক্ষের বেশি) দল বেঁধে গ্রামে চলে যাবে, সারাদিন ধরে তুলোর ফসল তুলবে! সেই তুলো একটা সরকারি সংস্থা বিদেশে রপ্তানি করে, লাভের সিংহভাগ চলে যায় কারিমভের জটের মধ্যে। কি ভাল ব্যাবসা বলুন ত?
কারিমভ কাকু গুগুশাকে নিজের রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। সব কিছুই প্লান মত চলছিল। গুগুশা এক আফগান-উজবেক ব্যাবসাদার পরিবারের ছেলেকে বিয়ে করেন, তার নাম মনসুর মাক্সুদি – তিনি আবার আমেরিকার নাগরিক। ওদের পাঁচটা প্রাসাদ ছিল – লন্ডন, নিউ ইয়রক, লস আঞ্জেলেস, পারিস আর তাশকেন্ত সহরে , বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন স্বামী স্ত্রী এবং ওদের দুই ছেলেমেয়ে। আগের লেখা থকেই বুঝেছেন যে ব্যাবসা ভালই চলছিল। কেউ কেউ বলে যে গুগুশার নিজের সম্পত্তির মুল্যায়ন প্রায় ৮০০০ কোটি ডলারের মতো হয়েছিল শেষকালে !!
কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে সবই বদলে গেল !! ২০০৫ সাল নাগাদ গুগুশা ছেলেমেয়েকে নিয়ে তাসখন্দে চলে আসে, অর স্বামী তখন ছিল আমেরিকায়। দুজনেই বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করে, তারপরে প্রচুর গণ্ডগোল সুরু হয়। সন্তান্ দের কাসটোডি নিয়ে, সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে, আমেরিকার কোর্ট এবং উজবেক কোর্টে প্রচুর মামলা শুরু হয়ে যায় , আস্তে আস্তে পরিবারের অন্যরাও এতে জড়িয়ে পড়ে। ইন্তারপোলের গ্রেফতারের পরোয়ানা বেরিয়ে যায় গুগুশার নামে, উনি আমেরিকায় এলেই নিজের ছেলেমেয়েদের কিডন্যাপিঙ্গ এর অপরাধে গ্রেফতার হবেন। আবার অনেক গ্রেফতারের পরোয়ানা বেরিয়ে যায় তাসখন্দে, মন্সুর জামাই ও তার পরিবারের লোকেদের নিয়ে , পুলিস তাদের হেনস্থা করতে শুরু করে।
গুগুশার নিজের জীবনধারাও এই সময় উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল । ওনার প্রেমিকদের সম্বন্ধ্যে গুজব প্রায়ই ছড়াত, শোনা যাচ্ছিল যে গুগুশা কারিমভ কাকুর যে উপদেষ্টাকে বিয়ে করতে চলেছেন বয়েস তার অনেক কম।
কারিমভ কাকু ডিকটেটর মানুষ , মেজাজ তুঙ্গে থাকে সবসময়। ২০১৩ সাল নাগাদ তিনি আর এসব সহ্য করতে পারলেন না। ঠিক কি হয়েছিলো বলা শক্ত, কিন্তু কাকু মেয়েকে কিছু চড়চাপড় দিয়ে গ্রেপ্তার করার আদেশ দিলেন, তারপর থেকেই গুগুশা তার প্রাসাদোপম বাড়িতে কয়েদি হয়ে রইলেন – house arrest!!
২০১৬ সালে কারিমভ হারট অ্যাটাক হয়ে মারা গেলেন। উজবেকদের আশা বাড়ল, এবারে নতুন্ সরকার এসে একটু স্বাধীনতা দেবে নাগরিকদের। ওমা , মুখে মুখে রিফরম আর স্বাধীনতার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত কিছুই হোল না। নতুন রাষ্ট্রপতি , শাভকাত মিরজি হলেন কারিমভ কাকুর ডান হাত, উনি কারিমভের আমলে প্রধান মন্ত্রী ছিলেন , এখন হয়েছেন রাষ্ট্রপতি।
নতুন প্রশাসন গুগুশাকে আরো ঝামেলায় ফেলল। নতুন করে, ঘুষখোর , দুর্নীতি এবং racketeering এর অভিযোগ আনল। বিদেশি তিনটি সরকার, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং আমেরিকা গুগুশার বিরুধ্যে নতুন সব অভিযোগ আনল। এই সব মামলার নিস্পত্তি হয়ে গেল শীঘ্রই উজবেকিস্তানের কাঙ্গারু কোর্টে , গুগুশার ১৫ বছর কারা দণ্ড হোল নতুন করে!! ফলে নিজের প্রাসাদোপম বাড়িতে থাকার বদলে ওনাকে উজবেক জেলে নিয়ে যাওয়া হোল।
সেখানেই এখন আছেন উনি। ওনার মেয়ে বড় হয়ে গেছে, সে মাঝে মাঝে মার লেখা পিটিশণ ইন্টারনেট -এ পোস্ট করে। সেখানে গুগুশা তার মানবিক অধিকার ধংস করা হয়েছে, ওনাকে মানসিক অত্যাচার করা হয়েছে, এই সব নিয়ে অভিযোগ করেন।
খুব একটা কেউ এসব নিয়ে পাত্তা দেয় না! কেনই বা দেবে?