টরনটোর আশু পুরোহিত
ক্যানাডার টরনটো শহরের এয়ারপোর্ট থেকে যদি হাইওয়ে দিয়ে শহরের দিকে যান, তাহলে মাঝখানে অনেক মাইল ধরে বেশী জনবসতি নেই, শুধু বড় বড় গুদোমঘর, কারখানা, পাইকারি আড়ত , গ্যারাজ, এইসবের মধ্যে কতকগুলো পুরনো দিনের পাথরের বাড়ি আছে, সেইগুলো সংস্কার করে কিছু অফিস বা বাড়ি বানান হয়েছে।
ওইখানেই একটু ভেতরের রাস্তায় দেখবেন একটা পাথরের বাড়ি, খুব সুন্দর করে সারানো হয়েছে, একটা বড় গেটের পাশে বসে আছেন সাদা চুল আর দাড়ি নিয়ে পাঞ্জাবী এক দাদু । দাদুর কাজ হচ্ছে বোতাম টিপে গেট খুলে দেওয়া। একটা বড় সাইন বোর্ডে লেখা Choutala’s Truck Garage and Truck Parts Shop.
বাড়ির পেছনেই একটা ট্রাকের গ্যারাজ আর তারই সঙ্গে একটা Junkyard, সেখানে ভেঙ্গে যাওয়া লরির নানারকম যন্ত্রপাতি থাকে।জাঙ্কইয়ার্ডএর ব্যাবসা ভালই, অনেকে পুরনো ট্রাকের রেডিয়েটর, কারবুরেটর, এমনকি ইঞ্জিন পর্যন্ত কিনে নিয়ে নিজেদের ট্রাকে লাগায়। ওই জিনিসগুলো অবহেলায় মাটিতে পড়ে থাকলে কি হবে, ওদের দাম অনেক।
ওই পাথরের বাড়িতে থাকেন মিস্টার প্রকাশ চৌতালা – হরিয়ানার লোক, কুস্তীগিরের মতো চেহারা, আর ওর স্ত্রী মধু (যার কথায় পরে আসছি), ওদের কিশোরী মেয়ে আর দাড়িওলা বুড়ো – প্রকাশের বাবা।
ওই বাড়ির পাশে একটা পুরনো খামার বাড়িকে সারিয়ে করা হয়েছে বাল্মীকি মন্দির, চৌতালা সাহেবের ট্যাক্স বাঁচানোর জন্যেই হবে হয়ত। ভেতরে বাল্মীকির মূর্তি, রামায়ণ লিখছেন, রাম লক্ষণ সীতা, এরাও আছেন, দেওয়ালে রামায়ণের বিভিন্ন রকমের ছবি আঁকা।
মন্দিরের পুরোহিত আশু ব্যানার্জি, একদম পশ্চিম বাংলার টাকি শহরের কাছে, ইছামতী নদীর ধারে একটা ছোট গ্রাম থেকে এসেছে। কি করে এলো সেটা অনেক জটিল গল্প, এখানে আর বলছি না। আশুর বাবা অনেক ছোটবেলায় মারা গেছেন, কিছু জমি আছে তার থেকেই ওর মায়ের আর ওর মোটামুটি চলে যেত। আশু নিজে নিজেই পড়াশোনা শিখেছে ভালই। কলকাতায় থাকলে আশু হয়ত ভাষাবিদ হতো, টাকির মতো জায়গাতেও ও ইংরিজি বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত খুব মন দিয়ে শিখেছে, টাকি কলেজ থেকে সংস্কৃত অনার্স নিয়ে বি এ পাস করেছে। পুরোহিতের কাজ নিয়েছে সুযোগ পেয়ে, আসলে কিন্তু আশু খুব একটা ধার্মিক নয়।বিয়ে করার ইচ্ছে আছে খুব! কিছু টাকা জমলে দেশে ফিরে গিয়ে সংসার করার প্ল্যান!
মন্দির আর চৌতালার বাড়ির পিছনেই হচ্ছে বিরাট জমি নিয়ে জাঙ্ক ইয়ার্ড, লরির পার্টস ছড়িয়ে আছে, আবার গোটা দশেক লরির ওখানে রাত্রের গ্যারাজও আছে। রাত্রিতে পুরো জায়গায় তালাচাবি লাগান হয়, চারটে বড় রটওয়েলার কুকুর ভেতরে ছেড়ে দেওয়া হয়, কেউ ঢুকলেই শেষ করে দেবে। জাঙ্কইয়ার্ডএর ঠিক মাঝখানে একটা ছোট্ট কটেজ, সেখানে থাকে গাঁজাখোর ক্যানাডিয়ান বিলি।
বিলির মাথাটা পুরো নরমাল নয়, আবার একটু খোঁড়া , বয়েস তিরিশের বেশি, ও কুকুরগুলোকে খাওয়ায় রোজ। কুকুরগুলো ওর কথাই শোনে শুধু। ওরা দিনেরবেলা বিলির ঘরের পাশে বেড়ার মধ্যে আটকে থাকে, বেশি চ্যাঁচামেচি করে না। আর বিলি গ্যারাজটার একটু দেখাশোনা করে দিনের বেলায়, খদ্দেরদের সাহায্য করে, ড্রাইভারদের সঙ্গে গল্প করে, বাকি সময় গাঁজায় দম মেরে বুঁদ হয়ে থাকে।
মন্দিরের পেছনেই একটা ছোট ঘরে আশু থাকে । তখন ও যা মাইনে পেত তাতে মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ কিছুই কিনতে পারেনি। ঘরে শুধু একটা বিছানা, একটা ছোট্ট টেলিভিসন আর একটা টেবিলে অনেক বই – সপ্তাহে একদিন চৌতালা সাহেব ওকে গাড়ি করে লাইব্রেরি নিয়ে যান, আশু অনেক বই ধার নেয়, আর লাইব্রেরির ইন্টারনেট থেকে নানারকম খবর পড়ে।
যদিও আশুর মাইনে কম কিন্তু মন্দিরের কাজও বেশি নয়। আশু সকালবেলা মন্দির পরিষ্কার করে খুলে দেয়, ছোট করে একটা পুজোর পরে দুপুরের প্রসাদ ও নিজেই বানায় ফল আর মিষ্টি দিয়ে।টরনটো বিশাল শহর, দুটো মস্ত বড় মন্দির আছে, ছোট মন্দির আছে অনেকগুলো। ফলে আশুর পুঁচকে মন্দিরে দিনেরবেলা খুব একটা কেউ আসেনা।
সন্ধ্যেবেলায় বড় করে পুজো, আরতি এইসব করে আশু। সপ্তাহে তিনদিন রামায়ণ পাঠ হয়, তার মধ্যে একদিন মূল সংস্কৃত বাল্মীকি রামায়ণ থেকে আশু পড়ে, বেশ কিছু লোক শুনতে আসে।
সপ্তাহে চার দিন একজন ভারতীয় রাঁধুনি এসে ভোগ রান্না করে দিয়ে যায় , অল্পসংখ্যক লোকই আসে, চৌতালার পরিবার ছাড়া। পুরী, সবজি, মিঠাই সব থাকে – খেতে ভালই।
এই সুন্দর পুণ্যের জীবনে কিন্তু মাঝে মাঝে বিঘ্ন ঘটায় বিলি। গাঁজা, মদ, সিগারেট সবই বিলি আশুকে অফার করে। মাঝে মাঝে বিলি ওর বাড়ির বাইরে গ্রিলে আগুন জালিয়ে বিফ, শুওর কত কিছু বারবিকিউ করে। এই সব লোভ আশুকে সামলাতে হয়।
কিন্তু মধু? চৌতালার বৌ মধু, বাড়ির পেছনে বেরোয় হামেশাই, গরমকালে শর্টস আর হাত কাটা জামা পরে, অন্য সময় টাইট জিনস আর গেঞ্জি পরে। ফুলগাছে জল দেয়, বাগানের যত্ন করে, বা মাঝে মাঝে বাড়ির পেছনের চাতালে বসে আরাম করে। বিলি আর আশু হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। মধু চৌতালার বয়স ৩২/৩৩ হবে, মুখ চোখ একেবারে কারিনা কাপুরের মতো, আর শরীরের গঠন ্কারিনা
কাপুরের থেকেও ভাল। ওকে দেখে দেখে গাঁজাখোর ক্যানাডিয়ান বিলি আর টাকির পুরোহিত আশু দুজনেই কুপোকাত। যখন সেজেগুজে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যায়, আশু জানলা থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে, আর একটা ধবধবে সাদা কামিজ পরে যখন মন্দিরে ভোগ খেতে আসে, তখন আশু আর চোখ ফেরাতে পারে না। মাঝে মাঝে মধু আশুর সঙ্গে একটু গল্প করে, আশু তখন তোতলাতে শুরু করে দেয় !!মধু তা শুনে মিটিমিটি হাঁসে।
বিলি মধুকে দেখে আর বলে “ What a fabulous MILF, man”!! আশু ইন্টারনেট থেকে MILF কথাটা শিখে নিয়েছে, ও বিলির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত!
এইভাবেই বেশ চলছিল, আশুর প্ল্যান ছিল পাঁচ বছর কাজ করে, টাকাপয়সা নিয়ে টাকিতে ফিরে যাওয়া। একদিন রাতে সব এলোমেলো হয়ে গেল।
তখন রাত প্রায় নটা, হটাত আশু শোনে চৌতালা সাহেবের গলা। ও নিজেই নিজের লরি চালিয়ে গ্যারাজে ঢুকছে, আর বিলিকে ডাকছে খুব জোরে। বিলি ছুটে গিয়ে আগে কুকুরগুলোকে আটকে দিলো, তারপর পাটাতন আর মই লাগিয়ে দিল লরির পেছনে। আশু দেখে অবাক ! গারাজের মধ্যে তো শুধু গাড়ি পার্ক করা হয়, মালপত্র (কার্গো) এখানে আসার কথা নয় তো।
লরির পেছনের দরজা খুলে গেল, আর প্রায় ষাট জন ভারতীয় চেহারার মানুষ নেমে এল। সবাই সোজা আশুর মন্দিরের চাতালে এসে বসে পড়লো। প্রত্যেকের পরনেই নোংরা জামা আর চান না করার জন্য ভীষণ গন্ধ – আশুর প্রায় বমি উঠে আ্সে আর কি!
হাসিহাসি মুখে চৌতালা সাহেব এলেন, আশুকে বললেন “ এই লোকগুলো এখানে দুদিন থাকবে, তারপরই চলে যাবে, তোমার চিন্তার কোন কারণ নেই”।
আশু বলল “এটা স্যার বাল্মীকির মন্দির , পবিত্র জায়গা, এখানে এইসব কেন করছেন”?
চৌতালা সাহেব উত্তর দিলেন “গুলি মারো পবিত্র জায়গার, ওরা এখানেই থাকবে, চান করবে মন্দিরের জলে, জামাকাপড় পরিষ্কার করবে।তুমি যদি সাহায্য কর, তোমাকে খুশী করে দেবো , নইলে, তোমার চাকরি হয়ত চলে যাবে, শরীরের ক্ষতি হবারও সম্ভাবনা আছে”!!
আশু খুব নিরীহ লোক। কিন্তু এইসব শুনে ওর মাথা গরম হয়ে গেল।
“এটা বাল্মীকি মুনির মন্দির, আর আমি এর পুরোহিত, এখানে আমার কথাই চলবে। আপনারা এখান থেকে বেরিয়ে যান”। এই বলে মন্দিরের ভেতরের দরজা বন্ধ করে ওর ঘরে চলে গেল রাগে কাঁপতে কাঁপতে।
প্রায় আধ ঘণ্টা পরে, আশুর মাথাটা ঠাণ্ডা হল একটু, ভাবতে শুরু করলো কি করা যায় এখন।
সেই সময়ই ওর দরজায় টোকা পড়লো। ভয় ভয় দরজা খুলে দেখে ওমা এতো মধু এসে গেছে ! প্রচুর পারফুম লাগিয়েছে, আর সেই সেক্সি সাদা জামাটা পরে আছে। ওপরের দুটো বোতাম আবার খোলা।
ওর হাত ধরে মিষ্টি হেসে মধু বললো “এইসব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছ কেন? চল আমি আর তুমি নায়াগ্রা ফলস চলে যাই। আমার গাড়িতে করে যাবে, একটা হানিমুন সুইট ভাড়া নেব। দুদিন ওখানে থাকবে আমার সাথে। যখন ফিরে আসব, সব ঝামেলা মিটে যাবে।
“আর মিস্টার চৌতালা”? আশু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
খিল খিল করে হেসে মধু বলল “আরে প্রকাশই তো আমাকে বলল তোমাকে নিয়ে যেতে । ফিরে আসার পরে ও তোমাকে একটা বিরাট বোনাস দেবে। যাও রেডি হয়ে নাও চট করে” ।
“ঠিক আছে , পাঁচ মিনিট” বলে আশু ভেতরে চলে গেল । খুব তাড়াতাড়ি আশু ভেবে নিল – একটা বিরাট গণ্ডগোল হতে চলেছে। কারিনা কাপুর ওকে গাড়ি করে নিয়ে যাবে আর দুদিন ওর সঙ্গে থাকবে, আবার ওর স্বামী আশুকে অনেক টাকা দেবে ফিরে এলে!! এইসব হয় নাকি?
আশু ঠিক করল, পালিয়ে যাবে এখনি। মধু যেই সরে গেছে, আশু ছুটে বাইরে পালিয়ে গেল। সোজা ছুট দিল পাশের বাড়ির দিকে। পাশের বাড়ি হচ্ছে একটা গুদোম ঘর, প্রায় ২০০ মিটার দূরে!
সেখানের ক্যানাডিয়ান সিকিউরিটি গার্ড বন্দুক নিয়ে ওর জন্যে রেডি হয়ে ছিল।
“কি চাই কি , হারামি”? সিকিউরিটি গার্ড আশুকে প্রশ্ন করল। লোকটা খুব একটা ভদ্র বলে মনে হল না।
আশু ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল “ চৌতালার বাড়িতে অনেক অবৈধ নাগরিক (illegal alien) এসে গেছে। প্লিস পুলিসে খবর দিন স্যার”।
কি ভাগ্য গার্ড মশাই তক্ষুনি পুলিশ ডেকে দিলেন। তারপরে সব সিনেমার মত হয়ে গেলঃ
প্রথমে দুটো, তারপরে দশ বারোটা পুলিশের গাড়ি এসে গেল, বিশাল সার্চ লাইট জালিয়ে সমস্ত অবৈধ নাগরিকদের এবং বিলি, প্রকাশ চৌতালা আর মধুকে হাতকড়া দিয়ে নিয়ে গেল। বাড়িতে পড়ে রইলো বুড়ো দাদু আর মধুর ছোট মেয়েটা। আশু গুটি গুটি ওর মন্দিরে ফিরে গেল, পুলিশকে জানাল যে ওই পালিয়ে গিয়ে ফোন করেছিলো। পুলিশ বলল “আপনার জবানবন্দি নিতে হবে, কাল সকালে অবশ্য যোগাযোগ করবেন”।
সব রাতেরই শেষ আছে। পরের দিন ঝকঝকে রোদ্দুর, আর তার মধ্যেই সাদা দাড়িওলা ঠাকুরদাদার সে কি গালাগালি! পাঞ্জাবী ভাষাটা আশু বোঝে না ভাল, কিন্তু বুঝল, আশুর বাবা মা এবং গাধা শূয়র ঘোড়া এইসবের নিকট সম্পর্ক নিয়েই ঠাকুরদাদা বকবক করছেন।শেষ কালে বললেন “নিকাল যাও আভি, শুয়ার কা বাচ্ছা”!
এই মিষ্টি কথা শুনে আশু তাড়াতাড়ি একটা বড় ব্যাগে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে সোজা ওর ব্যাঙ্কে চলে গেল। যা টাকা জমেছিল সব ক্যাশ করে নেবার পরেই পুলিশকে ফোন করল, একজন অফিসার ওর সঙ্গে দেখা করতে এলেন ব্যাঙ্কের বাইরে রাস্তার ওপরে। গাড়ী থেকে নেবে ওকে ডেকে বললেন
“হ্যালো, আমি টরনটোর পুলিশ অফিসার, বাংলা বলতে পারি একটু একটু , আপনার কেস আমিই দেখাশোনা করব”।
বুকের ওপর আইডিতে লেখা রয়েছে আবদুল, ইংরিজি একদম ক্যানাডিয়ানদের মতো বলে, বাংলা বোঝে ভালো কিন্তু বাংলা বলে ভাঙ্গা ভাঙ্গা, তাও বাংলাদেশের বাংলা , আবার আমেরিকার একসেন্ট দিয়ে, শুনতে খুব মজা লাগে।
“চলুন, ওই সামনের দোকানে গিয়ে একটু ব্রেকফাস্ট খাওয়া যাক” । খাওয়া হলে আবদুল বলল, “আপনার প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দী আমাদের লাগবে। আমি এক এক করে প্রশ্ন করব, আপনি পারলে ইংরিজিতে নয় বাংলাতে জবাব দেবেন। আমি বাংলা উত্তরগুলো অনুবাদ করে নোবো , আপনার সই দিয়ে দেবেন শেষে।
জবানবন্দী নেওয়া শেষ হয়ে গেলে আব্দুল সাহেব বললেন “ আপনাকে কোর্টে সাক্ষী দিতে হবে মনে হচ্ছে। একমাস এখন কোথাও যাবেন না”।
এই শুনে আশু খুব কাঁচুমাচু হয়ে বলল “কিন্তু আমার পুরোহিতের চাকরি তো আজ সকালে চলে গেছে, এক্ মাস নিজের পয়সায় এখানে থাকলে জমানো টাকা অনেক খরচা হয়ে যাবে”।
আব্দুল সাহেব একটু চিন্তা করে বললেন
“ ঠিক আছে, আমি অফিসে ফিরে গিয়ে দেখছি কি করা যায়, দু ঘণ্টা এখানে অপেক্ষা করুন”।
টরনটোর পুলিশের জবাব নেই। এক মাসের জন্যে আশুকে হোটেলে রেখে দিল, খাবার জন্যে পয়সা দিল আবার। যে কানেডিয়ান অফিসার আশুকে হোটেলে নিয়ে গেলেন, তার কাছ থেকেই আশু সব জানতে পারলোঃ
“ এটা হচ্ছে human trafficking, এই লোকগুলোকে ইন্ডিয়া থেকে পাচার করে আনা হয়েছে। এদেশে অনেক ইন্ডিয়ানদের কারখানা, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকান এসব আছে।এই লোকগুলোকে এইসব জায়গায় খুব কম টাকায় পরিচারকের বা মজুরের কাজ করান হবে। মিস্টার চৌতালা হচ্ছে স্থানীয় distributor, কিন্তু পেছনে অনেক রাঘব বোয়াল আছে যারা এই বিরাট আন্তর্জাতিক ব্যাবসা চালায়, বহু কোটি ডলারের ব্যাপার। আমরা মিস্টার চৌতালাকে ভয় দেখিয়ে এই পালের গোদাদের ধরার চেষ্টা করব। আপনি এখানে এক মাস থাকুন। এটা অফিস পাড়া , দিনের বেলা বেরোবেন, রাস্তায় প্রচুর লোক কোন ভয় নেই, দুপুরের খাবার খাবেন আর রাতের খাবারটা দুপুরবেলাতেই কিনে আনবেন। সন্ধ্যাবেলা হোটেল থেকে বেরবেন না মোটে ।এই দলের গুণ্ডারা কিন্তু আপনাকে খুঁজছে পেলে একদম লাশ ফেলে দেবে। গুড লাক”।
হোটেলে বসে বসে আশু শুধু ভাবে কি হতে পারতো । তিনদিন নায়াগ্রা ফলসে পরীর সঙ্গে সহবাস, আর ফিরে এসে প্রকাশের কাছ থেকে মুখ বন্ধ করার টাকা নিয়ে বড়লোকের মতো আরামে দেশে ফেরা যেত । জীবনে একবার খারাপ কাজ করলে আর কি হয়েছে!! যাকগে কি আর হবে? বাল্মীকি মুনির সম্মান তো রক্ষা হয়েছে।
আশুর ভাগ্যটা ভালো, এক সপ্তাহের মধ্যেই সব ঝামেলা মিটে গেল। বিলীকে একটু কড়কাতেই সে সব বলে দিলো, ভয় পেয়ে প্রকাশ বাবুও রাজসাক্ষী হয়ে গেলেন। কারিনা কাপুর, ইয়ে মানে মধুকে ছেড়ে দেওয়া হোল। এবারে আন্তর্জাতিক স্তরে উঠে গেল কেসটা, রাঘব বোয়ালের খোঁজে বিভিন্ন দেশের পুলিশ, এফ বী আই, ইন্টারপোল সব একজোটে কাজে নেবে গেলো।
আব্দুল সাহেবকে অনেক ধন্যবাদ দেবার জন্যে যাওয়ার আগে আশু একবার ফোন করল। খুবই খুশি মনে হল। আমেরিকান উচ্চারনে বাঙ্গাল ভাষায় প্রশ্ন করলেন
“খতধিন দ্যাসে zআন নাই? সখলে ভাল্ল আসে তো”?
হাসি চেপে আশু বলল “প্রায় আড়াই বছর হয়ে গেলো। চললাম স্যার। অনেক অনেক ধন্যবাদ”।
একেবারে আশু এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে উঠে গেলো। ওমা, খাবারের সঙ্গে একটা ছোট বোতল ওয়াইন দিয়ে গেলো, ফ্রী! সেই খেয়ে কি ঘুম! স্বপ্নে এলেন বাল্মীকি মুনি, আমেরিকান কায়দায় ভি সাইন দিলেন, তারপরে একটু আশীর্বাদ করলেন, পেছন থেকে রাম, লক্ষণ, সীতা, হনুমান আর জাম্বুবান একটু ভাঙ্গরা নাচ করে তাদের আনন্দ প্রকাশ করল, মধু একবার হাসিমুখে এসে ওদের দেখেই ভয় পালিয়ে গেলো ! খুশি মনে ঘুম থেকে উঠে আশুর মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেলো।
“অনেক হয়েছে , এবার ভবিষ্যতের প্ল্যান করতে হবে। যা টাকা জমেছে আড়াই বছরে, তাতে ইছামতী নদীর ধারে একটা ছোট দোকান খোলা যাবে, জমি আর দোকান থেকে মোটামুটি চলে যাবে। অবসর সময় সংস্কৃত চর্চা করা যাবে। হ্যাঁ বিয়ে একটা করতে হবে বইকি। কুমারসম্ভব, গীতগোবিন্দ , এইসব থেকে চমৎকার অংশগুলোর অনুবাদ করে বউকে পড়াতে হবে। আর রামায়ণ পড়তে হবে বাল্মীকির স্মরণে।
জয় বাল্মীকি মুনির জয়!