কিপটে কাকুর জিপসি প্রেমঃ প্রথম পর্ব

কিপটে  কাকুর জিপসি প্রেমঃ প্রথম পর্ব

“টাকার আণ্ডিল  জমাতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব !” এই ছিল রতন বাবুর motto।

আমরা ওর কথা  শুনে হাসতাম। আমেরিকা এসেছি , টাকা  তো কিছু হবেই  ভবিষ্যতে, আমাদের  তা নিয়ে খুব একটা চিন্তা  ছিল না।

পরে আমাদের সকলেরই অল্পবিস্তর টাকা হয়েছে।

 কিন্তু ছাত্র জীবনের প্রথম দিকটা  বড় ঝামেলায় কেটেছে। ভারতের বিভিন্ন জায়গা থেকে আমরা সব ভালো ভালো  ছাত্ররা  গবেষণা করতে এসছি – অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা,   রসায়ন , অর্থশাস্ত্র, এইসব বিষয়ে । আমরা পড়েছি  খুব নামী বিশ্ববিদ্যালয়তে, নামটা এক কথায় চিনবেন। কিন্তু আমাদের স্কলারশিপের পরিমাণ খুব কম ছিল।

একটা মস্ত বড় ফ্ল্যাটবাড়িতে সব ছাত্ররা থাকতো। প্রত্যেকটা ফ্ল্যাটে দুজন বা তিনজন ছেলে। ফ্ল্যাটের ভাড়া, ইলেক্ট্রিক বিল, মেডিক্যাল ইনসিওরেন্স , এইসব দেওয়ার পরে আমাদের কলেজের ক্যাফেটেরিয়াতে খাওয়ার পয়সাও থাকতো না।তখন মাইক্রোওয়েভ ছিল না, রামেন ছিল না, টোনির পিজা বলে একরকম পাওয়া যেত ওভেনে গরম করে খাবার জন্যে  – সে একেবারে কার্ড বোর্ডের মতো খেতে!!

চাল, আলু আর চিকেন কেনা হতো সুপারমার্কেট থেকে। রান্নাঘরে তিনজনে বসে আমরা হাঁ করে আস্ত frozen  চিকেনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতাম – এটাকে নিয়ে করব কি? সারাজীবন মা, বৌদি, দিদি এরা সব  আমাদের মত প্রতিভাবান ছাত্রদের যত্ন করে খাইয়ে এসেছে , রান্নাঘরে যাবার  তো কোন  দরকার হয় নি!!

যাই হোক, আস্তে আস্তে আমরা রান্না শিখলাম একটু একটু করে। দিনের বেলা পড়াশোনার চাপ, বিকেল ছটার মধ্যে  বাড়ি  ফিরে রান্না হত, দিনে একবার! ভাত, আলুভাজা, আর চিকেনের ঝোল – পরে ডাল , কপির তরকারী এইসব নতুন জিনিস যোগ হয়েছিল আর কি।

সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ  ফ্লাটের   রান্নাঘরে ভালই গন্ধ বেরত, খাবার রেডি, এই খেতে বসব আমরা। ঠিক  এই সময় রতনের উদয় হত।

“কি রে, করছিস কি, গন্ধ তো ভালই বেরোচ্ছে , কে শিখিয়েছে এসব?”  নিজেই একটা  প্লেট আর চামচ নিয়ে, একটু ভাত আর চিকেন তুলে নিত।

“বা বা চমৎকার চিকেন হয়েছে, একেবারে এ প্লাস । শুধু ফিসিক্স নয়, তোর রান্নাতেও  প্রতিভা আছে মনে হচ্ছে । কলকাতার কেউ বিশ্বাসই করবে না। চালিয়ে যাও গুরু!!”

একদিন হলে  ঠিক ছিল, কিন্তু সপ্তাহে তিনদিন এই ব্যাপার  হতে লাগলো। তারপরে শোনা গেল, অন্য  ফ্ল্যাটেও রতন যায় হামেশাই – একটু চিকেন, একটু মাছের ঝোল, একটু সাম্বার আর দোসা , একটু ছোলে আর চাপাটি – একেবারে অল ইন্ডিয়া ভোজ হয়ে যায় রোজই ।

আমরা  সব প্রদেশের ছেলে মীটিং করলাম। সবাই এক কথায় বলল ওই  শকুনকে ভাগাও। তারপর ছটা থেকে আটটা অবধি সব ফ্ল্যাটে নো  এন্ট্রি  শুরু হয়ে গেলো ! চালাকি নাকি! রতনের ভাগ্যে ফ্রি দেশি খাবার আর জুটল না।

আমরা সবাই কিছুদিনের মধ্যে Ph.D.  শেষ করলাম, চাকরিও পেলাম ভালো জায়গায় , আমেরিকার বিভিন্ন সহরে। রতনও ভাল চাকরি পেল। আমরা মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলতাম।

“ কি রে, টাকার বস্তা কত বড় হোল ?”

রতনও কম জায়না। “ আ রে, বস্তা ফেটে গেল বলে। তোদের মতো আমি নতুন গাড়ী কিনেছি নাকি? সব টাকা ব্যাঙ্কে ঢুকিয়ে  দিয়েছি । একটা রিসার্চ গ্রান্ট  পেলেই টাকার বস্তা ফুলে যাবে আরও। “

আমেরিকায় একজন প্রতিষ্ঠিত একাডেমিক হিসাবে রতন বাবু  কিছু  টাকা করে নিলেন, তার পরেই দেশে বাবা মার কাছে চিঠি গেল  “আমার বিয়ের জন্যে মেয়ে দেখো – শিক্ষিত এবং চাকরি করে এইরকম মেয়ে চাই, সুন্দরী না হলেও চলবে।
তারপর  এক মহিলা ডাক্তারের সাথে সম্বন্ধ করে রতনের বিয়ে হল। আমরা ভাবলাম অঞ্জলি, রতনের বউ, আমেরিকায় চলে আসবে। 
সাধারণত, এই সব ক্ষেত্রে, ডাক্তার  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়, তার মার্কিন মেডিকেল লাইসেন্স পেতে অতিরিক্ত কোর্স  নিতে হয় , আবার পরীক্ষা দিতে হয় আর আমেরিকার হসপিটালে শিক্ষানবিশ হয়ে থাকতে হয়।  এই সব করতে  বছর  পাঁচেক লেগে যায়। কিন্তু তোমার রতন কাকু  এর মধ্যে একদম গেল না।  ফোনে আমাদের বলল “আমরা দুজনে দুই জায়গায় ভালই কাজ করছি। একসঙ্গে হলে এখন আয় কমে যাবে। তাই অঞ্জলিকে বললাম – “ তুমি কোলকাতায় থাকো, আমি এখানে থাকবো - প্রতি গ্রীষ্মে আমার গ্রীষ্মের ছুটিতে তিন মাসের জন্যে তোমার  কাছে থাকব। আবার কি?””
 হুমম..., কম দাম্পত্য সুখ হল হোল কিন্তু নগদ টাকার বস্তা ভরে গেলো – রতন কাকুর কি মাথা দেখেছেন?
রতন বাবু তার স্ত্রীকে কখনো আমেরিকায় যেতে দেননি। 
"তুমি এখানে কাউকে চেন না, অঞ্জলি । আর আমেরিকায় দেখার কি আছে! শুধু কিছু উঁচু উঁচু বাড়ি !  তুমি কোলকাতায় থাকো, আমি এখানে থাকবো ।
 আমি প্রতি গ্রীষ্মে তিন মাস যাব এবং তোমাকে এবং আমাদের পরিবার এবং বন্ধুদের  সকলের সঙ্গে দেখা করব,  এক ঢিলে  অনেক  পাখী মারা যাবে হা হা!   
ডাক্তার  অঞ্জলি,  কলকাতায় ভালই প্রাকটিস  করছিলেন, রতনের টাকার বস্তায় সব যোগ  হয়ে যাচ্ছিল।  
বিয়ের তিন বছর পর অঞ্জলি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়ল । রতন আনন্দের সাথে শিশুটিকে ভারতে বড় করার পরিকল্পনা করছিল, আরও বেশি টাকা তাতে  জমবে, যখন একটা  খবর পেয়ে ওর মাথাটা একদম ঘুরে গেল। 

তখন মার্চের শেষের দিকে। রতন আমেরিকা থেকে অঞ্জোলির কলকাতার গাইনি  ডাক্তারকে ফোন করছিল। তিনি একটু  ইতস্তত  করে জানালেন, বেবি ডেলিভারি হবে অক্টোবর মাসে ।
 রতনের মাথায় রক্ত উঠে গেল “কি বলছেন কি ?” রতন ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করল।
আগের বছরের আগস্টে ভারত ছেড়েছিলেন রতন।
উফ! আসুন এখানে কিছু সহজ অঙ্ক করি।
 আপনি জানেন কিভাবে বাচ্চারা বড় হয়, তাই না?
এই বছরের জুন, জুলাই বা আগস্টে গর্ভধারণ করা একটি শিশু পরের বছর অক্টোবরে হবে না!
"এই বাচ্ছা আমার হতেই পারেনা, এর বাবা কে"? রতন ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করল
ডাক্তার বাবু চুপ করে রইলেন কিছুক্ষন, বললেন শেষে "অঞ্জলির সঙ্গে কথা বলুন" 
ফোনে বিশাল চেঁচামেচি কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেল, একেবারে কেলোর কীর্তি  ! 
রতন আর ভারতে যাওয়ার নাম করল না।
কিন্তু অঞ্জলিকে ডিভোর্স দেওয়া মানে ডাক্তারের টাকা থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া!
টাকার বস্তার অর্ধেক ছেড়ে দিন বা প্রতারিত স্বামীর  জীবন যাপন করুন - সাধারণ পুরুষদের জন্য এই সিদ্ধান্তটি খুবই সহজ হবে। 
 কিন্তু আমাদের কিপটে কাকুকে  এ নিয়ে ভাবতে হয়েছে। প্রায় পাঁচ বছর!! তখনই সেই জিপসি মেয়ের সাথে দেখা!

হ্যাঁ, আমেরিকায় জিপসি আছে! তারা বহু বছর আগে ইউরোপ থেকে এসেছিলো , অনেকে আমেরিকার মূল সমাজের সাথে মিশে গেছে।  যারা মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, তাদের মধ্যে কেউ সার্কাস এবং কার্নিভাল চালাত, কেউ কেউ গানের ব্যবসায় নেমেছিল , কিন্তু একটি ছোট অংশ ছিল যারা  নিজেদের অস্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রেখেছিল।

সিয়ারার মা, একজন শ্বেতাঙ্গ মেয়ে,  ষোল বছর বয়েসে  আমেরিকার একটা ছোট  সহরে   কার্নিভাল দেখতে গিয়ে এক ভীষণ সুদর্শন যুবকের দেখা পান – তার হাঁসি আর চোখ দেখেই ছোট মেয়েটা প্রেমে হাবুডুবু।

দুজনে পালিয়ে গেল    ক্যালিফোর্নিয়ায়্‌, ছেলেটি  কার্নিভালের কাজ ছেড়ে দিল।

কিন্তু এর ফল ভাল হয় নি খুব একটা । দেখা গেল ,ওই  জিপসি যুবক শুধু চুরি করতে পারে, আর মদ খেয়ে বউকে বেধড়ক  মারতে পারে।

প্রায় ষোল সতেরো  বছর এইরকম অত্যাচার  সহ্য করে    মেয়েটি পালাল, চলে এল ছোট  সহরে       ওর বাবা মার কাছে। সঙ্গে ওর চারটি ছেলেমেয়ে , সিয়ারা  তিন নম্বর সন্তান। কোন কোন  সময় দাদুর কাছে, কখনো মায়ের কাছে, কখন এক মাসীর  কাছে, এইভাবেই  সিয়ারা বড় হয়েছে  কিছুটা  অবহেলায়। কিন্তু সিয়ারা  তার বাবার কথা মনে রেখেছে,  মনের দিক থেকে সে একদম  সত্যিকারের জিপসি ছিল। কিন্তু রতন এসব কিছুই জানত না।

রতনের সঙ্গে সিয়ারার  দেখা হবার পরে কিপটে কাকুর জীবন একদম বদলে যায় । কিন্তু দ্বিতীয় পর্ব  না পড়লে এগুলো কিছুই জানতে পারবেন না !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *